এই পৃথিবী চলমান, কোন কিছুই থেমে নেই, চলতে চলতেই এখানে সেখানে পেয়ে যাই কিছু আনন্দ, পাই অনেক অনেক বেদনা, যুলুম-নির্যাতন। আনন্দিতের মন ভরে না, আনন্দ চাই আরো আরো, অন্ততঃ যতটুকু ভাল করেছি তার বিনিময় তো পাওয়া উচিত ছিল। ওদিকে নির্যাতিত প্রাণ কেঁদে কেঁদে নিঃশেষ অশ্রু বিন্দু, তবু কোথাও তার কথা শোনার কেউ নেই যেন, কি আইন, কি থানা, কি গ্রাম-গোত্র প্রধান, অবশেষে অবচেতন মনের আকুল আকুতি দু’হাতে শক্তি সঞ্চয় করে তুলতে থাকে আকাশের পানে, সেই আকাশে, যেখানে বিরাজ করছেন এই বিশ্ব-ভূবনের মহান স্রষ্টা। চিন্তারা এখানে এসেই থম্কে দাঁড়ায়, তাহলে কি তিনি দেখেন না, কেন তিনি এর প্রতিকার করছেন না?
দেখেন তো তিনি সবকিছুই, মানুষের অন্তর, আটলান্টিকের গভীরে বাস করা ক্ষুদ্র প্রাণীর কান্নাও তিনি শুনতে পান, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রাদির প্রতিটি নড়াচড়া তাঁর হুকুমেরই প্রতিক্রিয়া। এ প্রশ্নের জবাব মেলে তখনি, যখন মানুষ এবং অন্য সমগ্র সৃষ্টির আসা-যাওয়া, উত্থান-পতন ও কর্মপদ্ধতির ইতিহাসের পর্যালোচনা এসে কড়া নাড়ে কোন চিন্তাশীল মানুষের জ্ঞান ও বিবেকের দুয়ারে। প্রকৃত অর্থে এসব নিয়ে কেউ ভাবলে তার কাছে এ কথাই সত্য হয়ে ধরা দেবে যে, মানুষের জন্য পৃথিবী কোন স্থায়ী ঠিকানা নয়, তেমনি নয় কোন পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলসম্পন্ন জগৎ, যেখানে সে পাবে তার প্রতিটি কাজের সঠিক ফলাফল। তাহলে অর্থ কি দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এই যে, কর্মকালে বা স্থানে কিংবা পরীক্ষার হলে যেমন আমরা বেতন অথবা ফলাফল পাই না; আশাও করি না, তেমনি পৃথিবীর এই সামান্য ক’টি দিনও মানব জীবনের জন্য একটা কর্মস্থল, বীজতলা, পরীক্ষাক্ষেত্র মাত্র; এর বেশী কিছু নয়। যা কিছুই এখানে পাচ্ছি তা তো সেই মহান প্রতিপালকেরই দান, তাঁর প্রতিপালনের সাধারণ নীতি এই যে, যে তাঁকে বিশ্বাস করে আদেশ মেনে চলে, তাকেও প্রতিপালন করেন আর যে তাঁকে অবিশ্বাস করে আদেশ অমান্য করে, তাকেও তিনি সমভাবেই সব প্রাকৃতিক উপায়-উপাদান দিয়েই প্রতিপালন করছেন। তখন সিদ্ধান্ত এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ্ সবকিছু দেখা ও শুনা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে অর্থাৎ, পৃথিবীর কর্মজীবন শেষে পরকালে না পেঁৗছা পর্যন্ত তাঁর প্রতিপালন নীতির বাইরে কাউকে কোন সুবিধাই দেবেন না এখানে, যেমনটি করে থাকেন কোন মিল-কারখানার মালিক কিংবা আমাদের পরীক্ষার হলের পরীক্ষকগণ। এই পৃথিবী প্রতিদানের জন্য নয়; বরং পরীক্ষার জন্য, কে কত ভাল কাজ করে পরবর্তী অনন্ত জগতের জন্য অধিক সঞ্চয় করছে, আর কে অকল্যাণ সাধনে সাধনে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই নিজের ধ্বংস সাধন করছে। আর এখানেই নিহিত রয়েছে অজ্ঞান বা অর্বাচীনের প্রশ্নের জবাব। প্রয়োজন শুধু সত্যের সন্ধানে ভাবনার…।
ভাবনা ভেবেই আর কি হবে, নথিপত্র সংরক্ষণ করেই বা কি হবে, সবকিছুই তো বিলীনযোগ্য, বিলুপ্ত হবেই। তবুও এসবের সংরক্ষণ কার জন্য? -এই হলো আপাতঃ দৃষ্টির চিরন্ময় ফলাফল। কিন্তু অন্তদর্ৃষ্টি বলে ভিন্ন কথা, শোনায় ভিন্ন গাঁথা, বিলুপ্তি নেই কোন কিছুরই। আমার জীবনের সংরক্ষণ আমি করি বা না করি, অন্য কেউ তার সংরক্ষণে অতন্দ্র লেখক। দু’টি পর্যায়ে এই সংরক্ষণ কর্মটি সম্পাদিত হচ্ছে- (এক) আমাদের স্মৃতি বা স্মরণ-সঞ্চয়ণ যা আমাদের মাথায় প্রতিনিয়ত জমা ও উত্তরাত্তর বৃদ্ধি হচ্ছে এবং (দুই) আমাদের স্রষ্টা কতর্ৃক নিযুক্ত ‘সম্মানিত লেখকবৃন্দ’ যারা আমাদের স্মরণের চেয়েও সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্মভাবে লিখে রাখেন মানব মন, চিন্তা ও কর্মের প্রতিটি মুহূর্তাংশ।
পর্যায়ক্রমিক জীবনের পরবর্তী ধারাগুলো হবে এরই নিখুঁত পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে এবং তা অবশ্যম্ভাবী। যেমনটি আমরা বলে থাকি অবচেতন মনেই, যদি কখনো কোন বিপদের সম্মুখীন হই ঃ ‘কি পাপ করেছিলাম যে, আজ এই বিপদে পড়লাম’ আবার অন্যদিকে, ‘কোন ভাল কাজের ফলাফল দেখে আপন মনে যেমন এই প্রশান্তি ডেকে আনি যে, আমার এই ভাল কাজের জন্য এরূপই তো আমার পাওনা এবং অন্যরাও গল্প-কথায় বলে বেড়ায় যে, দেখ, ভাল কাজের জন্য তো এমনটাই হয়ে থাকে,’ এমন ধারার কিছু কথা। অর্থাৎ, মানুষের মন ও চিন্তার চিরন্তন বিচার এই যে, তার বিপদের কারণ নিজেরই কোন মন্দকর্ম কিংবা ভুল। বলাবাহুল্য যে, জানা-অজানায় ভুলই জন্ম দেয় প্রতিটি মন্দকর্মের। জেনে-বুঝে যা করছে, তা তার জানা কিংবা উপলব্ধির ভুল আর অজান্তে যা করা হচ্ছে, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তা জৈবিক কামনা-বাসনার বাহ্যরূপ।
তেমনি অন্যদিকে, তার কল্যাণের কারণও কোন সৎকর্ম বলেই তার বিশ্বাস আর যে কোন ভাল কাজের স্বাভাবিক দাবীও তাই, ব্যতিক্রম ঘটে কখনো কখনো স্রষ্টার নিগূঢ় রহস্যে; যা আমাদের সীমীত জ্ঞান-চিন্তা তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করতে অক্ষম, কিন্তু পরবর্তী কোন এক সময় জ্ঞানী মাত্রই তার জীবনের পর্যালোচনায় এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় যে, স্রষ্টা-প্রদত্ত তার সেই অতীত না পাওয়া কিংবা কষ্ট পাওয়াটা ছিল সম্পূর্ণ সঠিক। যার ফলাফল দূর-অদূর ভবিষ্যতে এমনকি জীবনের পরবর্তী কোন ধারায় সে অবশ্যই ভোগ করবেই, জীবনের সে ধারাটি হতে পারে তার মৃতু্যর পরও; নিশ্চিত।
কিন্তু যে কথাটি বলতে যাচ্ছিলাম, আমাদের জীবনে এমন বহু সৎ-অসৎ কর্ম সম্পাদিত হয়, কখনো তার ফলাফল আমরা আমাদের জীবদ্দশায়ই পেয়ে যাই, কখনো পাই না। কেউ তো পাপে-দূস্কৃতিতে তার নিজ দেহ থেকে শুরু করে প্রতিবেশী, সমাজ, দেশ এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও পৃথিবীকে যন্ত্রণাময়, বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। পৃথিবীর আদালতে তার পাকড়াও হলেও চুড়ান্ত সাজা হিসাবে বিচারক নিতে পারবেন শুধুমাত্র তার একটি প্রাণ; অথচ সে কেড়ে নিয়েছে শুধুমাত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অধিবাসীদের মধ্য থেকেই দুই থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ প্রাণ, বিচারকের কি সাধ্য যে তার থেকে অন্ততঃ আরো একটি প্রাণের নাজ্য বিচার প্রয়োগে সত্যিকারের সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করবেন? পৃথিবীর সমস্ত আইন, সমস্ত আদালত এখানে এসেই অক্ষম, অসহায়। অপরাধীর শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ডের বিনিময়ই তারা নিতে পারেন, যদি তার অপরাধ হয় অন্ততঃ দু’টি হত্যাকাণ্ড, তাহলে আরেকটি হত্যার শাস্তি দেয়ার জন্য ফাঁসির পর আরেকটি হত্যার শাস্তি ভোগ করাতে জীবন্তরূপে তাকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে না পৃথিবীর আইন।
অন্যদিকে, একটুখানি মিষ্টি হাসি দিয়ে কখনো কখনো প্রাণের শত্রুকেও আপন করে বন্ধু বানানো যায়, মৃতু্যপথযাত্রী কোন শিশু জন্য দু’একশ’ টাকার ঔষধ কিনে দিলে দেখা যায় সে সুস্থ হয়ে পৃথিবী গড়ার কাজে পেয়ে যায় আরো 40/50 টি বছর (অনিশ্চিত), স্কুল-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, রাস্তা-ঘাট তৈরীসহ চিন্তা-কর্মে যাদের পুরো জীবনটাই শুধু দান-অবদানে ভরপুর, কি পাচ্ছে তারা পৃথিবী থেকে, কিইবা দিচ্ছে তাদের উপকৃতরা, আর কতটুকু সাধ্যই বা আছে পৃথিবীবাসীর সেই মহতের সৎকাজের বিনিময় দানে? সুস্থ-পরিচ্ছন্ন চিন্তাশীল মাত্রই সূক্ষ্ম ভাবনায় পড়বেন এ দু’টি ভিন্নমূখী দিক নিয়ে, সন্দেহ নেই।
যে কোন প্রকার আচ্ছন্নতা মুক্ত ব্যক্তিও এরপর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, এই পৃথিবী সত্যিকারের সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম নায্য বিচারের জন্য উপযুক্ত কোন স্থান নয়; বরং এখানে ইচ্ছা এবং পূর্ণনিষ্ঠা থাকলেও কেউ সৎ কিংবা অসৎ কাজের পরিপূর্ণ প্রতিদান যেমন দিতে পারে না, তেমনি পেতেও পারে না। তাই সিদ্ধান্ত এই যে, ‘এই সূক্ষ্ম সুবিচারের জন্য এমন একটা জগৎ দরকার যেখানে থাকবে না এ জাতীয় সংকীর্ণতা ও দুর্বলতা। যেখানে অপরাধী বা খুনী দু’টি খুন করলে তাকে একটির জন্য একবার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার পর তার প্রাণহীন দেহে দ্বিতীয় খুনের শাস্তির জন্য প্রাণ সঞ্চার করিয়ে আবার ফাঁসিতে ঝুলানো সম্ভব।
অন্যদিকে সৎকর্মী যদি দু’টি প্রাণকে বাঁচিয়ে তোলার মত সৎকাজের প্রচেষ্টা করে থাকে, তাহলে একই সময় দু’টি প্রাণ যে পরিমাণ সুখ-শান্তি-আনন্দ উপভোগ করতে পারে, ঠিক সে পরিমাণ প্রতিদানও ঐ ব্যক্তি একাই উপভোগ করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যার সৎ ও অসৎ কাজের পরিমাণ যত বেশী, সে তত বেশী শান্তি কিংবা শাস্তি লাভ করবে।
মানুষের ধর্ম, মানবতার জন্য পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ইসলাম এই বিশেষ জগতেরই নামকরণ করেছে ‘আখেরাত’ বা মৃতু্যর পরবর্তী অনন্ত জীবন।
Filed under: আদর্শ: ইসলাম | Leave a comment »