শৈশবের রেশ কেটে উঠিনি তখনো, যেমন কাটেনি ভোরের রেশও, সেদিনের সকালে। কিছু আগেই তো শেয়ালের ডাকে দুরু দুরু বুকে হাতুড়ি-কাঠে পেরেকের ঠুকাঠুকি অবস্থা আর ভোর-পূর্ব সোবহে সাদিকের ঠাণ্ডায় যেন কনকন শব্দ হচ্ছিল। তারও আগে কাঁথার আদরে বেঘোরে নিদ্রিত ছিলাম নানার আদরে। অনেক টানা-হিঁচড়ার পর চোখ মেললাম, শিশুবেলা আর ছেলেবেলার ঘুমটা এমন ছিল যে, চোখ জাগলেও কান জাগতে জাগতে কিছুটা সময় নিত। অবশেষে কানের ঘুম ভাঙ্গতেই শুনতে পেলাম ঘরজুড়ে বেশ হৈচৈ ব্যস্ততা আর এসবের থেকে সম্পূর্ণ দূরে ওপাশের রুমেই শুধু হাল্কা ব্যথিত শব্দ হচ্ছিল যেন, গিয়ে দেখতেই অবাক দেখলাম। রাগে টুইটুম্বর নানার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে, তিনি কাঁদছেন, ভাবতেই অবাক লাগছিল; অথচ দু’চোখে দেখছি। সেদিনই টের পেলাম প্রথম- রাগি মানুষগুলোর আড়ালে একটা খুব স্পর্শী-নরম মন লুকিয়ে থাকে। সকলের কান্না আর কাঁদো-কাঁদো ব্যস্ততা এবং ঘুম জাগা চোখ কচলাতে কচলাতেই দেখি রাতের পোষাক উধাও; আমরা দু’ভাই বেশ সাহেব সাহেব সেজে গেলাম।
শীতের ঘুম আর দুষ্টোমীর আড়ালেও সেই রাতে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, প্রিয় গুরুজনেরা শাসন করলেও কতটা মমতা জড়িয়ে আমরা অবস্থান করছি তাদের প্রতিটি হৃদয়ে হৃদয়ে, আরো জেনেছি সকল রাগ, সকল ঘৃণা-বিদ্বেষ একটা সময়ে এসে মিশে যায় সময়ের দ্রবণে- সে সময় হলো বিদায়ের ক্ষণ। যে বিদায় আজ শুধু চোখের আড়াল কিন্তু পৃৃথিবীর কোথাও না কোথাও তো বেঁচে আছি, ব্যথিত হই তখনি, যখন এই আড়ালই হয় চিরদিনের। ফিরে গিয়ে আর খুঁজে পাই না প্রিয় প্রিয় মুখগুলো, খুঁজে পাই দু’পাশ থেকে উঁচু করা একটা ছোট্ট মাটির ঢিবি, সবাই দেখিয়ে দেয়- এখানেই তিনি ঘুমোচ্ছেন, জাগিও না তাকে, জাগিও না…। এই আসা-যাওয়ার হিসাব-নিকাশে আমরা কত অসহায়। আমাদের অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষা- বিদায়ের; যদিও কেউই চাই না চলে যাই।
তেমনি, ঠিক তেমনি বলা ঠিক হবে না, তারও কিছু কাছাকাছি অনুভবে অপেক্ষমান আমরা ক’জন, বাবা, মা, আমি, মাসুদ আর পিচ্ছি জসীম, কখন আসবে ট্রেন, কখন…কখন…। জানিনা কখন, অপেক্ষা কখনো স্টেশনের ইতিউতি, কখনো আম গাছটির তলার দুর্বা-বিছানায়, কখনো কদম তলায়, এভাবেই।
(ক্রমশ…).