بسم الله الرحمن الرحيم
وَالْفَجْرِ * وَلَيَالٍ عَشْرٍ *
অর্থ: ফজরের সময়ের শপথ, আরও শপথ দশ রাত্রির।
নামকরণ ও পরিচিতি: সূরা আল-ফজর। প্রথম আয়াতের الْفَجْرِ শব্দটিকে নাম হিসেবে নেয়া হয়েছে।
আয়াত সংখ্যা ৩০। মোসহাফের তারতীব অনুযায়ী ৮৯ নং সূরা।
নাযিলের সময়কাল: মাক্কী সূরা। সূরা আল-লাইলের পরে নাযিল হয় ও নাযিলের তারতীব অনুযায়ী ১০।
বিষয়বস্তু: জ্বিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের ফযীলত ও আমাদের করণীয়।
শাব্দিক ব্যাখ্যা: وَ =শপথ অর্থে। الْفَجْرِ =ফজরের সময়। لَيَالٍ =রাত্রিসমূহ। عَشْرٍ =দশ।
বিস্তারিত ব্যাখ্যা:
 আল্লাহর খাস রহমত এমন কিছু মওসুম।
 জ্বিলহজ্জের প্রথম দশ দিন তেমনি এক মওসুম।
 কোরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এ দিনগুলোর ফযীলত:
১. আল্লাহ্ কুরআনে শপথ করে মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। আল্লাহ্ কিছুর শপথ ঐ সময়ই করেন যখন তার মর্যাদা তাঁর কাছে অনেক বেশী হয়। তিনি বলেনঃ وَالْفَجْرِ * وَلَيَالٍ عَشْرٍ
 ইবনে কাসীর (রঃ) বলেনঃ এ আয়াতে জ্বিলহজ্বের প্রথম দশ দিন উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
২. আল্লাহ্ কুরআনের অন্যত্র এ দিনগুলোতে বেশী করে তার যিকর করার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি বলেনঃ
وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ . “আর তারা যেন আল্লাহকে নির্দিষ্ট কিছু দিন স্মরণ করে”। [সূরা আল-হাজ্জঃ ২৮]
 ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাফসীরে বলেনঃ আয়াতের এ অংশ দ্বারা জ্বিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন বুঝানো হয়েছে।
৩. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেনঃ “এ দশ দিনে অনুষ্ঠিত যে কোন নেক কাজের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোন দিনে কোন নেক কাজ হতে পারে না”। সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেনঃ এমনকি জিহাদও এর মত নয়? রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “জিহাদও এর সমপর্যায়ের নয়, অবশ্য যদি কেউ এমনভাবে জিহাদে বের হয় যাতে নিজের জান মাল সব কিছুই ব্যয় করেছে, তারপর আর কিছু নিয়ে ফিরে আসেনি” (তাহলে এমন ব্যক্তির মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে)। [বুখারীঃ ৯৬৯, আবু দাঊদঃ ২৪৩, তিরমিযীঃ ৭৫৭,৭৫৮, ইবনে মাজাহঃ ১৭২৭, ১৭২৮, দারেমীঃ ১৭৭৩, ১৭৭৪]।
৪. আবদুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “এ দশ দিনে অনুষ্ঠিত যে কোন নেক কাজ অন্যান্য সময়ে কৃত অন্য কোন নেক কাজের চেয়ে আল্লাহর কাছে অনেক বেশী মর্যাদাসম্পন্ন, এবং বেশী প্রিয়। সুতরাং তোমরা এ দিনগুলোতে বেশী করে তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ কর”। [আহমাদঃ ২/৭৫, ১৩১]।
৫. রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মহান দিন হলো কুরবানীর দিন, তারপর (মীনায়) অবস্থানের দিন” [আবু দাউদঃ ১৭৬৫]
 এখানে কুরবানীর দিন হলো দশ তারিখ, আর অবস্থানের দিন হলোঃ আইয়ামে তাশরীকের দিন তথা এগার, বার, এবং তেরই জ্বিলহজ্জ।
৬. সা’ঈদ ইবনি জুবাইর রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ দশ দিনে ইবাদত করতে করতে অপারগ হয়ে যেতেন। [দারেমীঃ ১৭৭৪ হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন]।
৭. আল্লামা ইবনে হাজার (রহঃ) বলেনঃ এ দশদিনের এত ফযীলতের কারণ আমার কাছে যা স্পষ্ট হচ্ছে তা হলোঃ এ দিনগুলোতে যাবতীয় বড় বড় ইবাদাতসমূহ একত্রিত হয়ে থাকে, যেমনঃ সালাত, রোজা, সাদকাহ তথা দান খয়রাত এবং হজ্জ। এ দিনগুলো ছাড়া অন্য সময়ে এত ইবাদাত একত্র হয়না। [ফাতহুলবারী ২/৫৩৪]
৮. আলেমগণ বলেনঃ যাবতীয় দিনের মধ্যে জ্বিলহজ্জের প্রথম দশদিন সবচেয়ে উত্তম দিন, আর যাবতীয় রাত্রিসমূহের মধ্যে রমজানের শেষ দশ রাত্রি উত্তম রাত্রি।
এ দিনগুলোতে একজন মুমিনের কী কী করণীয়
১. হজ্জ ও উমরাহ্ আদায় করাঃ এ দিনগুলোতে সবচেয়ে উত্তম কাজ হলোঃ হজ্জ ও উমরাহ্ আদায় করা।
 রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “এক উমরাহ্ থেকে আরেক উমরাহ্ এ দুইয়ের মাঝখানের যত গুনাহ আছে মিটিয়ে দেয়, আর আল্লাহর নিকট মাকবুল হজ্জের একমাত্র পুরষ্কার হলো জান্নাত” [বুখারীঃ ১৭৭৩, মুসলিমঃ ১৩৪৯]।
২. সালাতঃ বেশী বেশী নফল সালাত আদায় করা, বিশেষ করে সালাতের জন্য আগে আগে হাযির হওয়া। এমনিতেই সালাত অতি উত্তম কাজ, তার উপর রয়েছে এ সময়ের ইবাদাতের অতিরিক্ত ফযীলত।
 সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “তুমি বেশী বেশী সিজদা (সালাত আদায়) করবে, কেননা তোমার একটি সিজদা তোমাকে এক নতুন মর্যাদায় উন্নীত করবে, আর তোমার একটি গুনাহ থেকে তোমাকে মুক্তি দিবে”। [মুসলিমঃ ৪৮৮]।
৩. সাওম বা রোজাঃ এ দিনগুলোতে সাওম পালন করা মুস্তাহাব। সাওম এমনিতেই সওয়াবের কাজ, তদুপরি তা সংঘটিত হচ্ছে অতি উত্তম সময়ে।
 হুনাইদা বিন খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূল (সাঃ) এর কোন এক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন যে, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জ্বিলহজ্জের নয় তারিখ, আশুরার দিন, এবং প্রতি মাসে তিন দিন সাওম পালন করতেন”। [আহমাদঃ ৫/২৭২, আবুদাউদঃ ২৪৩৭, নাসায়ীঃ ২৩৭২, ২৪১৭]।
 ইমাম নববী বলেনঃ এ দশদিন রোজা রাখা মুস্তাহাব।
 হাজী ব্যতীত অন্যদের জন্য জিলহজ্জের নয় তারিখ সাওম পালন সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আমি আল্লাহর কাছে আশা করবো তিনি এ দিনের সাওমের কারণে পূর্ববতী এবং পরবর্তী বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন”। [মুসলিমঃ ১১৬২, আবু দাঊদঃ ২৪২৫, তিরমিযীঃ ৭৫৯]
৪. তাহলীল, তাকবীর, তাহমীদঃ এ দিনগুলোতে বেশী বেশী করে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহু আকবার পাঠ করা।
 রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “তোমরা এ দিনগুলোতে বেশী করে তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ কর”। [ইমাম আহমাদ তার মুসনাদেঃ ২/৭৫, ১৩১]।
 ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেনঃ “ইবনে উমর এবং আবুহুরায়রা (রাঃ) জ্বিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন তাকবীর দিতে দিতে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হতেন, আর লোকেরা তাদের তাকবীর শুনে তাকবীর দিতেন”। [সহীহ বুখারীঃ কিতাবুল ‘ঈদাইন, বাবঃ ফাদ্বলুল ‘আমালি ফী আইয়ামিত তাশরীক্ব]
 তিনি আরো বলেনঃ “ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মিনায় তার তাঁবুতে এমনভাবে তাকবীর বলতেন যে, মসজিদেও তা শুনা যেত, ফলে মসজিদে অবস্থানকারীগণও তার তাকবীর শুনে এমনভাবে তাকবীর দিতেন যে, সমস্ত মিনা তাকবীর ধ্বনীতে প্রকম্পিত হত”।
 আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা মিনাতে এ দিনগুলিতে তাকবীর দিতেন, প্রত্যেক সালাতের পরে, শয্যা গ্রহণের সময়ে, তাঁবুতে অবস্থানকালীন সময়ে, বৈঠকখানায়, হাঁটা চলার সময়, সর্বাবস্থায়।
 এ তাকবীর উচ্চ স্বরে দেয়া মুস্তাহাব, যেমনটি ইবনে উমার ও আবুহুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। একসাথে সমস্বরে তাকবীর দেয়া হাদীস বা সালফে সালেহীনের আমল দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি, তাই সমস্বরে তাকবীর দেয়া যাবে না। তবে শিক্ষার উদ্দেশ্যে যেতে পারে।
 কুরআন ও হাদীসে যত রকমের তাকবীর, তাহমীদ, তাসবীহ এসেছে সবগুলিই বলা যাবে।
 তাবেঈনদের মধ্যে যারা ফকীহ হিসাবে প্রসিদ্ধ তারা জ্বিলহজ্জের প্রথম দশদিন যে তাকবীর পড়তেন তা হলোঃ “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ”।
 এ ধরনের তাকবীর এ দিনগুলোতে সব সময়ে দেয়াই মুস্তাহাব, বিশেষ করে বাজারে, বাড়ীতে, রাস্তা-ঘাটে, অলিতে-গলিতে, মসজিদে।
 ফরয সালাতসমূহের জামাতের পরে দেয়া বিশেষ ভাবে নির্দিষ্ট।
 হাজীদের জন্য তাকবীরের সময় হলোঃ দশ তারিখ (কুরবানির দিন) জোহরের সালাতের পর থেকে।
 যারা হাজী নন তারা তাকবীর শুরু করবেনঃ নয় তারিখ (আরাফার দিন) ফজরের সালাতের পর থেকে।
 প্রত্যেকের জন্যই এই নির্দিষ্ট তাকবীরের সময়সীমা তের তারিখ (আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন) আসরের সালাতের পর পর্যন্ত নির্ধারিত।
৫. কুরবানী করাঃ আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের হালাল মাল থেকে কুরবানীর পশু কিনে তা জবাই করা।
৬. তাওবা করাঃ যাবতীয় গুনাহ থেকে নিবৃত হওয়া, যাতে করে আল্লাহর রহমাতের অধিকারী হতে পারে।
 গুনাহ মানুষকে আল্লাহ থেকে দুরে সরিয়ে দেয়, আর নেক কাজ মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়।
 আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ আত্মসম্মানজনিত কারণে ক্রোধান্বিত হন, আর আল্লাহর ক্রোধাগ্নি উদ্রেক করে ঐ সময় যখন কেউ তার হারামকৃত বস্তুতে উপনীত হয়”। [বুখারীঃ ৫২২৩, মুসলিমঃ ২৭৬১]
৭. বেশী বেশী করে সৎকাজ করাঃ অতিরিক্ত পরিমাণে সালাত আদায়, সাদাকা প্রদান, জিহাদে অংশ গ্রহণ, কুরআন পাঠ, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের থেকে মানুষকে নিষেধ করা। এই সমস্ত নেক কাজ বেশী বেশী সওয়াবের অধিকারী করে।
‍‍~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
 আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম এ দিনগুলোতে বেশী বেশী সৎকাজ করে তাঁর প্রিয় বান্দা হবার তাওফীক দান করুন। আমীন।
 সমাপ্ত 

ডাউনলোড ওয়ার্ড ভার্সন: sura al fajr 1-2.