২৫তম মৃত্যু-বার্ষিকীতে
শ্রদ্ধাঞ্জলী
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা চির
অম্লান প্রজন্ম
থেকে প্রজন্মে
দীপায়ন
খীসা
মানবেন্দ্র লারমা নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামের এক বীর সেনানীর নাম।
রাংগামাটি জেলার অদূরে
মাওরুম নামক এক গ্রামে ১৫
সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সালে লারমার জন্ম।
১৯৬০-এর দিকে পাকিস্তান
সরকার যখন কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো তখন লারমা কলেজ ছাত্র।
পাহাড়ের চির দুঃখী
মানুষদের ভিটে-মাটি ডুবিয়ে দেয়ার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ছাত্র লারমা অনুধাবন করতে
সক্ষম হন।
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার
জন্য ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করতে থাকেন।
অচিরেই লারমা রাষ্ট্রীয়
নিপীড়ণের শিকার হন।
পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী
তাকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে।
১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রয়ারী
লারমাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ
লারমা জেল থেকে মুক্তি পান।
কারাগারে আটক অবস্থায়
লারমা বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৭০ সালে তরুণ লারমা
পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
এভাবে তিনি পার্বত্য
অঞ্চলের নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে
সক্ষম হন।
বাংলাদেশ
স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন করার
প্রাক্কালে লারমা উগ্র আধিপত্যবাদী বাঙালী জাতীয়তবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন।
তিনি পার্বত্য
চট্টগ্রামের জন্য পৃথক শাসন ব্যবস্থাসহ জুম্ম জণগণের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দাবি করেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে
আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রীয় শক্তি লারমার ন্যায্য দাবিকে প্রত্যাখান করে।
জুম্ম জনগণের পাশাপাশি
দেশের কৃষক, তাঁতি, জেলে, মাঝি-মাল্লা, কলকারখানার শ্রমিক-সহ
সকল মেহনতি মানুষের অধিকারের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য লারমা গণপরিষদে
সোচ্চার দাবি রেখেছিলেন।
সংবিধানে সকল ধর্ম ও
নারীর সমমর্যাদা রক্ষার জন্য লারমা বারংবার আইন প্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
সংবিধান প্রণয়নের সময়
লারমা ছিলেন নিসঙ্গ অভিযাত্রী।
কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ছিলো
অমিত তেজ।
গণপরিষদে বার-বার তাঁর মাইক
বন্ধ করা হলেও ফ্লোর পেলেই তিনি জুম্ম জনগণের কথা, নারী অধিকার এবং মেহনতি
মানুষের মুক্তির কথা বলতেন।
লারমা সাম্যবাদী দর্শনের
সৈনিক ছিলেন ছাত্র জীবন থেকেই।
মার্কসীয় সমাজ বিজ্ঞানকে
আত্মস্থ করে শ্রমজীবি মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাংখা থেকে তিনি সংবিধান
প্রণয়নের সময় শ্রমিক, মেহনতি জনতা ও নিপীড়িত
জাতিসমূহের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছিলেন।
পার্বত্য
অঞ্চলের নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তির লক্ষ্যে লারমা ১৯৭২ সালে গড়ে তোলেন জন সংহতি
সমিতি।
তাঁর সুদক্ষ সাংগঠনিক প্রতিভার
কারণে জন সংহতি সমিতি দ্রুত জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলে পণিত হয়।
শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে
থাকা, সামন্তবাদের শৃংখলে আবদ্ধ জুম্ম
জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে লারমা পাহাড়ে এক নবতর ইতিহাসের সূচনা
ঘটান।
পার্বত্য অঞ্চলের জন্য
স্বায়ত্ত্ব-শাসন
ও জুম্ম জনগণের সাংবিধানিক
স্বীকৃতির
নিয়মতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ হয়ে
গেলে জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগষ্ট
আত্মগোপনের মাধ্যমে লারমা সশস্ত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
জনসংহতি সমিতির পাশাপশি
মহিলা সমিতি, জুমিয়া সমিতি, যুব সমিতি ও গিরিসুর
শিল্পী গোষ্ঠী গঠনে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন।
মহিলা সমিতির সদস্যদের
গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে লড়াইয়ের সম্মুখ সারিতে নিয়ে আসতে লারমা অনুপ্রেরণা
যোগাতেন।
গ্রাম্য বিচার ব্যবস্থাকে
সামন্ত প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত করে তিনি গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করে বিচার
পদ্ধতিতে সাধারণ জুমিয়াদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন।
জুম্ম জনগণের সমাজ
জীবনকে সাম্যবাদী ব্যবস্থায় পরির্তনের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় লারমা নিবেদিত
ছিলেন।
একই সাথে
লারমার নেতৃত্বে অধিপতি রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা
শান্তিবাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
পাশাপাশি পাল্টা আঘাত
হানার মধ্য দিয়ে শান্তিবাহিনী জুম্ম জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামকে এক নতুন উচ্চতায়
নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
নিপীড়ক রাষ্ট্রের শাসন
ব্যবস্থার বিপরীতে জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলে সাম্যবাদী ধারার
নিজস্ব প্রশাসন চালু করার অনন্য গৌরব গাঁথা রচনা করে।
প্রচলিত সকল
ধ্যান-ধারনাকে বদলে দেয়ার মাকর্সীয় দর্শনের সফল অনুশীলনে লারমা কখনও আপোষ করেননি।
সেই কারণে সাম্রজ্যবাদী
অনুচরেরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে।
কথিত দ্রুত নিষ্পত্তির
ধুয়ো তুলে সংগ্রামকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করার আয়োজনে লিপ্ত হয় তারই কিছু সহকর্মী।
অনেক রক্ত, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য
দিয়ে গড়ে উঠা প্রতিরোধ সংগ্রামকে বিভক্ত করার জন্য এই কুচক্রীরা অপঘাতমূলক তৎপরতা
শুরু করে দেয়।
লারমা পার্টি এবং প্রতিরোধ
লড়াইকে ঐক্যবদ্ধ রাখার সুমহান দাযিত্ববোধ থেকে এই বিভেদকামীদের ক্ষমা করে দেন।
'ক্ষমা কর এবং ভুলে যাও'
এ-নীতির ভিত্তিতে তিনি জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে ঐক্য প্রক্রিয়া চালু
রাখেন।
দলীয়
ঐক্যকে সংহত করার লক্ষ্যে লারমা ভিন্ন
মতাবলম্বীদের
সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে
সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা
সে-দিকে পথ মাড়াননি।
১০ নভেম্বর ১৯৮৩ গভীর
রাতে তারা লারমার গোপন ঘাঁটিতে হামলা চালায়।
প্রিয় নেতাকে রক্ষার
জন্য লারমার সহযোদ্ধারা আমরণ লড়াই চালিয়ে যান।
জুম্ম জনগণের মহান
নেতাকে রক্ষার সকল প্রতিরোধ অতিক্রম করে ঘাতকরা লারমার কাছে পোঁছে যায়।
ঘাতকের নির্মম বুলেট
নিপীড়িত জনতার মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসেনানী লারমার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়।
১০
নভেম্বর, ১৯৮৩ জুম্ম জনগণের মীরজাফরদের
বুলেটে নিভে যায় লারমার জীবন প্রদীপ।
ঘাতকের বুলেট লারমার
জীবন কেড়ে নিয়েছে তা সত্য।
তবে লারমার আত্মত্যাগ, তাঁর জীবন দর্শন
প্রতিনিয়ত নিপীড়িত মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
নির্লোভ ও নির্মোহ জীবন
যাপনে লারমা চিরকাল অনুকরণীয়।
মৃত্যুর পূর্বক্ষণ
পর্যন্ত কোনো প্রকার ভোগবাদ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
অদর্শ ও নীতির প্রশ্নে
তিনি ছিলেন সব সময় আপোষহীন।
সাচ্চা, ত্যাগী বিপ্লবী এ-নেতার
জীবন তাই মরণেই থেমে থাকে না।
ঘাতকরা ইতিহাসের
আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হয়েছে অনেক আগে।
কিন্তু লারমা চির
দীপ্যমান।
বর্তমান
সময়ে নষ্ট রাজনীতির কবল থেকে জনগণকে মুক্ত করতে লারমাকে আত্মস্থ করা তরুণ প্রজম্মের
জন্য খুবই জরুরি।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রতিনিয়ত
ভোগবাদে আকৃষ্ট করার, পুঁজির লোভের মায়াজালে
বিপথগামী করার নানান আয়োজনে আমাদের যুসমাজকে প্রলুব্ধ করছে।
পশ্চিমা সংস্কৃতির
আগ্রাসনে আমাদের সমাজ জীবন কঠিন এক সংকটকাল অতিক্রম করছে।
লারমার প্রিয় জুম্ম
জনগণও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির স্রোতে অবগাহন করতে দ্বিধাবোধ করছে না।
জুম্ম জনতার মুক্তি
সংগ্রামকে বিপথে পরিচালিত করতে অনেক মহান (?) মহান (?) দাতাগোষ্ঠী পার্বত্য
অঞ্চলে তাদের লোভনীয় কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে।
এমনি এক সংকটকালীন সময়ে
১০ নভেম্বর
আমাদের আদর্শবোধকে পুনর্জ্জীবিত
করতে, চেতনাকে শানিত করতে অনুপ্রাণিত
করবে।
লারমার মৃত্যুর ২৫ টি বছর
পেরিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু পাহাড়ের নিপীড়িত জনতা
তাদের প্রিয় নেতাকে একটি মুহুর্তের জন্যও ভুলে থাকেনি।
প্রতিটি সংগ্রামে, প্রতিরোধে, আত্মবলিদানের মহান পথে
লারমা এখনও পথপ্রদর্শক।
তাই ১০
নভেম্বর এলেই পাহড়ের জনপদে বেজে উঠে
শোকের সুর।
পাহাড়ের
স্রোতস্বিনী
ঝর্ণাগুলি, সুউচ্চ চুড়াগুলো, বন-বনানী তাদের প্রিয়
নেতার জন্য নতুন শপথ পাঠ করে।
যারা মনে করেছিলো
লারমাকে হত্যার মাধ্যমে তাঁকে জুম্ম জনগণের মনোজগত থেকে বিদায় করা যাবে, তাদের সেই চিন্তা পরাজিত
হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
সে-কারণে
১০ নভেম্বর
এলেই ঘাতকদের হৃদয় প্রকম্পিত
হয়ে উঠে।
মেকী ও প্রতি- বিপ্লবীদের আসল
চেহারা উন্মোচন হয়ে যায়।
কথিত দ্রুত নিষ্পত্তির
লড়াই সাম্রাজ্যবাদী ও দেশীয় শাসকদেরই বাতলে দেয়া একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে জনগণের কাছে
পরিষ্কার হয়ে যায়।
এভাবে লারমা আরও বেশি
অমিত তেজে জনতার মাঝে ফিরে আসে।
সাম্রাজ্যবাদী অনুচরদের
সকল ষড়যন্ত্র লারমার লড়াকু ও নির্লোভ জীবনের কাছে নেতিয়ে পড়ে।
লারমা শুধু জুম্ম
জনতাকে নয় পৃথিবীর সকল নিপীড়িত ও শোষিত মানুষকে সাম্যজ্যবাদকে পরাজিত করতে সাহসী
করে তুলে।
সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণ করতে
তাঁর অবিচল পথ চলা প্রজম্ম থেকে প্রজম্মকে আলোড়িত করে যাবে।
মার্কসবাদকে ব্যক্তি ও
সমাজ জীবনে চর্চা করতে লারমা নতুন প্রজম্মের জন্য অনন্তকাল এক উজ্জ্বল অনুকরণীয়
হয়ে থাকবেন।
তাই বিপ্লবী লারমার মৃত্যু নেই।
দীপায়ন খীসাঃ সম্পাদক, মাওরুম
|