News-Bangla - নিউজ বাংলা - Bangla Newspaper from Washington DC - Bangla Newspaper

০৬ মার্চ ২০১৬, রবিবার      
মূলপাতা
ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রিন্ট কর
সাহেদুর রহমান মোরশেদ   
রবিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০

একুশের প্রথম কবিতা "কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি"- এ কবিতার জনক, রাউজানের সন্তান, মরণোত্তর একুশে পদক ২০০৯ প্রাপ্ত ভাষা সৈনিক প্রয়াত কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫২ ও '৭১-এর এক অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী।

সাহিত্যে, সাংবাদিকতায়, সমাজ সংস্কারে, মানবসেবায় - সব ক্ষেত্রেই তিনি আদর্শবাদী, ত্যাগী, সাহসী কণ্ঠস্বর ছিলেন। এ ভূখন্ডে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যত আন্দোলন, সংগ্রাম হয়েছে তার প্রতিটিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।

মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের গহিরা গ্রামে ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মরহুম আহমদুর রহমান চৌধুরী, মাতা মরহুমা রওশন আরা বেগম। রোমান্টিক ভাব-প্রবণতায় উজ্জ্বল মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন রাউজানের গহিরা হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র অবস্থায় ১৬ টাকা বৃত্তিও পেতেন তিনি। কিন্তু তখনকার পূর্ব বাংলার গভর্নর কলেজ পরিদর্শনে এসে ছাত্রদের উদ্দেশে কলেজ মিলনায়তনে বক্তৃতাকালে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কটু মন্তব্য করে আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন।

১৯৪২ সালে তিনি সপ্তদশ বা অষ্টাদশ বর্ষীয় তরুণ তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র কংগ্রেসে যোগদান এবং ছাত্র কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে যোগদান করেন ছাত্র ফেডারেশনে। একই সালে চট্টগ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে কলকাতা থেকে আসেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, ভবানী সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। সম্মেলনে তিনি এর কর্মী হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ওই বছর তিনি চট্টগ্রাম প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের জন্মজয়ন্তীর অন্যতম সংগঠকও ছিলেন তিনি।

১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের নতুনপাড়ায় অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২ জন সৈনিক নিকটস্থ কাহারপাড়া গ্রামে এক মহিলার শ্লীলতাহানি করলে পাড়ার লোকেরা তাদের মারধর করে। পরের দিন সেনাবাহিনীর একটি দল পেট্রল দিয়ে কাহারপাড়া পুড়িয়ে দেয়। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। বিশ্ব শান্তির পক্ষে বাংলাদেশে প্রথম প্রচারক ও স্বাক্ষর সংগ্রহের কৃতিত্বও তাকে দিতে হবে। কারণ বিশ্ব শান্তির স্বপক্ষে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৮ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি ওই সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রগতিশীল মাসিক "সীমান্ত" তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় (১৯৪৭-১৯৫২)। তার "সীমান্তের দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা" (১৯৫০) দুই বাংলার প্রগতিশীল আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে তার প্রচেষ্টায় রাউজানের গহিরা হাইস্কুলের সাহায্যার্থে স্কুল মাঠে "ইন্সপেক্টর জেনারেল" নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ওই বছরেই তার সম্পাদনায় "সীমান্ত" পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ২২ ও ২৩ নভেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় দেশবন্ধু পার্কের বিশ্ব শান্তি সম্মেলন। সেই সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং শহীদ সাবের যোগদান করেন। ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আবদুস সালাম। সেখানে কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, শান্তির সংগ্রাম ও বাঁচার সংগ্রাম এক হয়ে গেছে। সম্মেলন শেষে মিছিল বের হলে পুলিশ মিছিল থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরীসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে কলকাতার তালতলা থানায় নিয়ে যায় এবং পরে তাকে আলীপুর জেলে প্রেরণ করে। ৩ দিন পর তাদের মুক্তি দেয়া হয়।

৫০ দশকের প্রথম দিকে তার সক্রিয় প্রচেষ্টায় গঠিত হয় "প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ"। সীমান্ত পত্রিকায় তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের (১৯৫০) ডাকে আণবিক বোমা নিষিদ্ধিকরণের দাবিতে ব্যাপক প্রচার চালান ও স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামেও বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখা স্থাপন করেন। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ওই পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। সভাপতি ছিলেন আবদুল হক দোভাষ। ১৯৫১ সালে দিল্লিতে কবি পাবলো নেরুদার সঙ্গে দেখা করেছিলেন তখন নেরুদা পাবলো তাকে একটি বই উপহার দেন। ওই বছরই মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিহত শহীদের স্মরণে প্রথম কবিতা "কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি" রচনা করেন। ১৯৫২ সালের ১০ অক্টোবর জওশন আরা রহমানের সঙ্গে তার শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি রাউজান গহিরা ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে জড়িত করেন। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক "স্বাধীনতা"র ১৯৭২-৮২ সাল পর্যন্ত সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন এ পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন এবং ৯০ দশকে প্রায় ৮ বছর ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন। ক্রান্তির সভাপতি হিসেবে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে বাংলা একাডেমী কর্তৃক ফেলোশিপ এবং ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী কর্তৃক সংবর্ধনা দেয়া হয়। এভাবে ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামের অনোমা সাংস্কৃতিকগোষ্ঠী, ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম সংগীত পরিষদ, ২০০০ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, ২০০১ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ২০০২ সালে পদাতিক নাট্য সংসদ কর্তৃক সংবর্ধনাসহ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবিকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিকগোষ্ঠী সংবর্ধনা প্রদান করে। এ ছাড়া ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি মঞ্চের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা ও একুশে পদক দেয়া হয়। ২০০৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় পুরস্কার, ২০০৬ সালে ঋষিজ পদক ও সংবর্ধনা দেয়া হয়। ২০০৬ সালে ভাষা আন্দোলন, জাতীয় পুরস্কারসহ মরণোত্তর একুশে পদক ২০০৯ দেয়া হয়।

কবির প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: কবিতার বই: আবেগধারা (১৯৪৪), ইস্পাত (১৯৪৫), অঙ্গীকার (১৯৫৬), কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি (১৯৮৮, ২০০২, ২০০৫), সূর্যাস্তের রক্তরাগ (২০০৪), সূর্যের ভোর (২০০৬)। প্রবন্ধের বই: সংস্কৃতি : জাতীয় মুখশ্রী (২০০৬), নির্বাচিত কলাম : গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র (২০০৬), ছড়ার বইয়ের মধ্যে ছড়ায় ছড়ায় (২০০৪), নাটক : দারোগা (১৯৯৪), (হুমায়ুন কবিরের ভূমিকা সংবলিত), আগামীকাল (১৯৫৩) (সীমান্ত পত্রিকায় ক্রম প্রকাশিত), পুস্তিকা : মিসরের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৫৬); বিপ্লব (বাজেয়াপ্ত ১৯৪৬)।

ভাষা সৈনিক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। বর্তমান প্রজন্ম এ কবি সম্পর্কে অনেক কথাই জানে না। তাই রাউজানসহ চট্টগ্রামবাসীর দাবি ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য বইয়ে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে জানতে পারে। সূত্র: দৈনিক ডেসটিনি।

সর্বশেষ আপডেট ( সোমবার, ১৪ জুলাই ২০১৪ )
 

Add comment


Security code
Refresh

< পূর্বে   পরে >
Free Joomla Templates