মহান আল্লাহ্ তা’আলা মানব জাতির জন্য নির্ভেজাল ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এমন এক জীবন ব্যবস্থা দান করেছেন, যা থেকে আমরা যেমন সত্য ও সঠিকের দিকনির্দেশনা পাই তেমনি পাই মিথ্যা ও ভ্রান্তির পরিচিতিও। এটা এ জন্যে যে, দয়াময় আল্লাহ্ আমাদের কল্যাণ চান। তাই কোথায়, কোন পথের কোন বাঁকে ওঁত পেতে আছে অকল্যাণ সে ধারণা আমাদেরকে পূর্ব হতেই জানিয়ে দিয়েছেন; যাতে আমরা সতর্ক থাকতে পারি। কিন্তু তবুও কি মিথ্যার ধ্বজ্জাধারী আর বিভ্রান্তরা থেমে আছে? নেই; থাকতে পারে না, কেননা তারা যে বিক্রিত হয়ে গেছে শয়তানের কুচক্রী ষড়যন্ত্রের কাছে। তাই তাদের প্রত্যেকেই এক একজন শয়তান অথবা শয়তানের প্রতিনিধি হয়ে আমাদের সমাজে নিজেদের ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। কবর পূজারী ও কবরের উপর প্রাসাদ নির্মাণকারীরা এই ব্যাপক গোমরাহ্ গোষ্ঠীর একটা অংশ। গুটিকতক দুর্দান্ত চালাক ব্যক্তিকে শয়তান সম্পূর্ণরূপে ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে মানব সমাজের একটা বিরাট অংশকে মোহাচ্ছান্ন করে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দোরগোড়ায়। আসুন দেখা যাক, কবরের উপর নির্মাণ-তা দেয়াল হোক কিংবা প্রাসাদ-প্রসঙ্গে ইসলাম কি দিকনির্দেশনা দিচ্ছে আমাদেরকে।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি:
আল্লাহ্ তা’আলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে নবী নূহ ‘আলাইহিস্ সালাম কর্তৃক তার অবাধ্য জাতির জন্য কৃত বদদো’আ তুলে ধরার মাধ্যমে আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে কিভাবে পৃথিবীতে মৃতদের  পূজা, তাদের কবরে পূজা ও তাদের মূর্তি বানিয়ে সেসবের পূজা করার সূত্রপাত ঘটেছিল-  وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آَلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا  ((তারা (নূহের জাতির কর্তৃত্বশীল লোকেরা) বলছে, (সর্বসাধারণের প্রতি) তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ‘ওয়াদ’, ‘সুওয়া’আ’, ‘য়াগূছ’, ‘য়া’উক’ ও ‘নাসর’কে।)) [সূরা নূহ: ২৩]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: ((এই সবক’টি মূলত নূহ্ ‘আলাইহিস্ সালামের সম্প্রদায়ের কতিপয় নেককার লোকের নাম। তাদের মৃত্যুর পর লোকেরা শয়তানের প্ররোচণায় তাদের ভাস্কর্য নির্মাণ করে প্রতিটি ভাস্কর্যকে আসল নামে ডাকতে শুরু করে। তখনো এগুলোর পূজা করা শুরু হয়নি। কিন্তু তাদের পরবর্তী বংশধরগণ মূর্খতাবশত এগুলোর পূজা করতে শুরু করে।)) [বুখারী হতে ইবনে কাসীর] ইকরিমা, যাহ্হাক, কাতাদাহ্ ও ইবন্ ইসহাক রাহিমাহুমুল্লাহ্ হতেও এই বর্ণনা পাওয়া যায়।
-এখানে সুস্পষ্ট যে, মৃত ব্যক্তিদের প্রতি অতিভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে প্রথমে ভাস্কর্য ও পরে মূর্খতার কারণে পূজা-অর্চনা শুরু হয়ে যায়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: لَا تَجْلِسُوا عَلَى الْقُبُورِ وَلَا تُصَلُّوا إِلَيْهَا ((কবরের উপর (আসন গেঁড়ে বা ইমারত বানিয়ে) বসো না এবং তার দিকে (কবরের দিকে) সালাত আদায় করো না।)) [মুসলিম: ১৬১৩, আবূ দাউদ: ২৮১০, তিরমিযী: ৯৭১, আহমাদ: ১৬৫৮৪] যদি সাধারণ অর্থে ধরে নেয়া হয়, তবে কবরের উপর বিরাট ইমরাত নির্মাণ করে সুসজ্জিত করা তো দূরে থাক, আল্লাহর রাসূল এখানে বসতে পর্যন্ত নিষেধ করেছেন। আর বিস্তারিতভাবে বুঝতে হলে কবরের উপর যা কিছু নির্মাণ করা হয় অথবা ইবাদাত-নিয়মপন্থা-নযর-মান্নত-অর্থদান ইত্যাদি  করা হয়, শুধুমাত্র যিয়ারতের শরীয়ত সম্মত সঠিক পন্থা ব্যতীত আর সকল কৃতকর্মের ব্যাপারের এখানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

যদি ধরে নেয়া যায় যে, তারা প্রচণ্ড ভালবাসার কারণে কবরের উপর প্রাসাদ নির্মাণ করে ফেলেছে কিংবা অধিক মাত্রার ভালবাসার কারণেই বার বার তাদের কবরে গিয়ে কান্নকাটি করছে। তবে তাদের আত্মসমালোচনা করা উচিত যে, তারা কি পরম প্রিয় আল্লাহর জন্য তাদের হৃদয়ে তেমন ভালবাসা পোষণ করে? অথচ বান্দার জন্য ভালবাসার সবটুকু কিংবা সর্বোচ্চটুকু হওয়া উচিত তার প্রতিপালকের প্রতি। যেমনটি তিনি বলেছেন:
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آَبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا
((তারপর যখন তোমরা হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করবে যেভাবে তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষদের স্মরণ করে থাক, অথবা তারচেয়েও অধিক।)) [সূরা আল-বাকারা: ২০০] সুতরাং পূর্বপুরুষ বা সম্মানিত কোন ব্যক্তিত্ব যত প্রিয়ই হোক না কেন; আল্লাহ্ বলছেন যে, তার চেয়েও অধিক ভালবাসা বান্দার কাছ থেকে তাঁর প্রাপ্য। বান্দার উচিত অন্তরে তার রবের প্রতি ভালবাসার সর্বোচ্চ মাত্রাকে জাগরিত রেখে তাঁকে স্মরণ করা। অন্যত্র তিনি বলেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ
((আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তারা তাদেরকে ভালবাসে আল্লাহর ভালবাসার মতই ; পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাসে।)) [সূরা আল-বাকারা: ১৬৫] সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, যারা অন্য কোন মানুষকে আল্লাহর আল্লাহর ভালবাসার মত করে ভালবাসে তারা মূলত সেই ব্যক্তিকে নিজ নিজ অন্তরে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে। আর আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করা সুস্পষ্ট শির্ক। পরন্তু আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে যে, মুমিনগণই শুধুমাত্র আল্লাহকে তাদের অন্তরের সর্বোচ্চতা দিয়ে ভালবাসে অর্থাৎ, এর ব্যতিক্রমীরা ঈমানের দিক থেকে সুস্পষ্ট বিপদাশংকায় নিমজ্জিত। তাহলে একথা সুস্পষ্ট যে, যারা কবরবাসীকে ভালবাসার কারণে কবরের উপরে সুরম্য দেয়াল বা প্রাসাদ নির্মাণ করে অথবা কবরবাসীকে ডাকে তারা প্রকারান্তরে সেই কবরবাসীকে আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। যার ভয়াবহ পরিণাম সুস্পষ্ট শির্ক!

কবরের উপর মসজিদ স্থাপন করা ও তাতে বাতি জ্বালানো প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে আরো বর্ণিত আছে যে: ((তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কবরসমূহে নারী যিয়ারতকারিনীদের, সেখানে (কবরের উপর) মসজিদ স্থাপনকারীদের এবং সেসবে (কবরসমূহে) বাতি জ্বালানোওয়ালাদের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করেছেন।)) [আবু দাউদ: ২৮১৭, তিরমিযী: ২৯৪, নাসায়ী: ২০১৬, আহমাদ: ১৯২৬, ২৪৭২, ২৮২৯, ২৯৫২]

প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কবর সম্পর্কে আমাদের হুশিয়ার করে গেছেন যে: ((তোমরা আমার কবরকে ঈদগাহ বানিও না এবং তোমাদের গৃহগুলোকে কবর বানিও না।)) [মুসনাদে আহমাদ: ৮৪৪৯]

এছাড়াও কবরস্থানে মসজিদ তৈরি করা কিংবা মসজিদে কবর বানানো ইসলামে হারাম বলে ঘোষিত হয়েছে। কেননা কবরের প্রতি সম্মান দেখানো ও তাতে ইবাদত করা পর্যায়ক্রমে শির্কের মত অধঃপতনের প্রতি মানুষকে নিয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ((আল্লাহ তাআ’লার অভিশাপ ইহুদি ও খৃষ্টানদের উপর তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে।)) [বুখারী ও মুসলিম] জুন্দুব রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পূর্বে তার নিকট হতে পাঁচটি অসিয়ত শুনেছেন, সেগুলোর মধ্যে একটি হল কবরকে মসজিদে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি। হাদীসে এসেছে:   وإن من كان قبلكم كانوا يتخذون قبور أنبيائهم و صالحيهم مساجد ، ألا فلا تتخذوا القبور مساجد ، فإني أنهاكم عن ذلك
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ((তোমাদের পূর্ববর্তীরা নবী ও সৎ লোকদের কবরকে মসজিদ বানাতো। সাবধান! তোমরা কবরকে মসজিদ বানিও না। আমি তোমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করছি।)) [মুসলিম] তাই কবরস্থানে জানাজার সালাত ব্যতীত অন্য কোন সালাত বৈধ নয়।

এবার দেখা যাক যুক্তি কি বলে:
গৃহের প্রকারভেদ: গৃহ, ঘর, প্রাসাদ, ইমরাত ইত্যাদি যাই বলি না কেন, এসবের মৌলিক বিভাজন মূলত তিনটি- থাকার ঘর, কাজ করার ঘর এবং ইবাদাত-উপাসনার ঘর। কেউ কেউ আরো অন্যান্য ছোট ছোট ঘরের কথা তুলতে পারেন, কিন্তু সেসবগুলোই এই মৌলিক তিন প্রকারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। তাহলে লক্ষ্য করুন- কবরের উপর যে দেয়াল অথবা প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তার উদ্দেশ্য কি? সেখানে কেউ থাকবে? কেন থাকবে? নিজের শান্তিময় ঘর ফেলে কোন জীবিত মানুষ কি কারণে কবরের উপরে ঘর বানিয়ে থাকতে চাইবে? অথচ কবর বা মৃত্যুর নাম শুনলে এমন কোন মানুষ নেই যার অন্তর কেঁপে উঠে না। আবার যদি বলা হয় যে কাজের জন্য, তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, কি কাজ তার কবরের উপর? কোন সুস্থ জীবিত মানুষ কবরের উপর কল-কারখানা, দোকান কিংবা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করবে না; যে করবে সে অবশ্যই কোন দূরভিসন্ধি নিয়েই করবে। যদি বলা হয় যে, ইবাদাত-উপাসনার জন্য, তাহলে তো উপরের আলোচনায় ইসলামের যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে তা থেকে উক্ত ব্যক্তির গোমরাহী সুস্পষ্ট এবং সচেতন মুসলমানদের উচিত তাকে এ থেকে বিরত রাখা। ইসলামী সরকার হলে উচিত উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা যাতে অন্য কেউ এরূপ জঘন্য কর্ম সম্পাদন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ না পায়।

থাকার ঘর: থাকার ঘর আমরা কেন নির্মাণ করি? তার কয়েকটি কারণ ও কবরের সাথে তুলনা দেখুন-
রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য: কবরের বাসিন্দার জন্য কি রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্জা থেকে বাঁচার জন্য ঘরের প্রয়োজন আছে? অবশ্যই নেই, কেননা মাটির যে বদ্ধ ঘরে সে ঘুমিয়ে অথবা যে মাটির সাথে সে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে, সে মাটির উপরে কি হচ্ছে তাতে তার কিছুমাত্র যায় আসে না। পরন্তু সে মূলত এখন অন্য জগতের বাসিন্দা, তাই এ জগতের কোন কিছুর স্পর্শই তাকে ছুঁতে পারে না। ঘরে বাতি জ্বালানোর মত করে কবরে মোমবাতি জ্বালানো হয়, বলুন তো- সে আলো কি আদৌ কবরবাসী পর্যন্ত পৌঁছায়? তারা তো কবরে কোনরূপ ফাঁক-ফোঁকরও করে না, তাহলে উপরে বাতি জ্বালানো হয় কার জন্য? এটা কি এ জন্য নয় যে, তাদের চিন্তা মত অর্থের পতঙ্গরা ছুটে আসবে আর ভরে দেবে তাদের পেতে রাকা মটকা-হাঁড়ি। কি প্রকাশ্য লুণ্ঠন!

পারিপার্শ্বিক ভীতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমরা গৃহ নির্মাণ করি: কবর বাসীর কি সে ধরনের কোন ভয় আদৌ আছে? কখখনোই নেই। এই পৃথিবীতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ভয় হলো মৃত্যুর ভয়, তাহলে যে ব্যক্তি এই ভয়কে অতিক্রম করে গেছে, তার জন্য আর কি বাকী আছে নশ্বর এই ধরাধামে? কিছুই নেই; বরং পৃথিবীর কারুরই কোন সাধ্য নেই মৃত কোন ব্যক্তির বিন্দুমাত্র ক্ষতি সাধন করে। চাই সে লাশের কবর হোক কিংবা না হোক। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক কা’বার সীমানায় আক্রান্ত ও অবরুদ্ধ হয়ে আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে তার মা আসমা বিনতে আবি বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমের নিকট গমন করেন, তখন তিনি ছিলেন অন্ধ, হাতড়ে ফিরে যখন ছেলের গায়ে লোহার বর্ম দেখলেন, তখন বললেন: তুমি কি ভয় পাও? তিনি বললেন: শুনেছি হত্যা করার পর তারা লাশকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। বীরাঙ্গনা মা বললেন: বাবা, আমরা যে গবাদী পশু জবাই করে কেটে-কুটে রান্না করে খাই, তাতে কি তাদের কোন কষ্ট হয়? হয় না। উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের কিন্তু ভয়ে বর্ম পরেননি; বরং মাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য পরেছিলেন এবং কথাগুলো বলেছিলেন। কেননা, পরবর্তীতেও দেখা গেছে যে, তার লাশ গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং ওনার মাকেই তা নামিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কথাগুলো একদিকে যেমন বীরত্বগাঁথা তেমনি প্রাসঙ্গিক আলোচনায় অসাধারণ উদাহরণ, তাই উল্লেখ করলাম।

লজ্জা নিবারণের জন্য আমরা গৃহ নির্মাণ করি: কিন্তু মৃত ব্যক্তি তো মাটির বদ্ধ ঘরের আড়ালেই থাকেন অথবা মিশে যান, তাহলে যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, চিরদিনের জন্য যিনি আড়ালে চলে গেছেন, তার জন্য লজ্জা নিবারণ কিংবা একান্ত কর্ম সুরক্ষার জন্য কি প্রাসাদ নির্মাণের কোন প্রয়োজন আছে? অবশ্যই নেই। বরং ব্যাপার যে অন্য কিছু তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সৌন্দর্য বা অহংকার প্রকাশের জন্য গৃহ নির্মিত হয়: ভেবে দেখুন, কবরবাসীর জন্য কি মৃত্যুর পর সৌন্দর্য কিংবা অহংকার প্রকাশের কোন সুযোগ আছে? অবশ্যই নেই; বরং উত্তরসূরী কেউ কবরের উপর সুরম্য প্রাসাদ কিংবা দেয়াল নির্মাণ করলে তার পেছনে অবশ্যই কোন পার্থিব স্বার্থ কিংবা উত্তরসূরী তার নিজের অহংকারই কবরবাসীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে এর মাধ্যমে। আর অন্য কেউ নির্মাণ করলে তার উদ্দেশ্য এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, সে এর মাধ্যমে অর্থময় দৃষ্টিসমূহকে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

কাজের জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করে থাকি আমরা: কিন্তু কবরবাসীর জন্য তো আর কোন প্রকার কাজ করারই কোনরূপ সুযোগ নেই, কেননা সে মরে গেছে। তাহলে কাজ করবে কারা? জীবিতরা? কি কাজ করা যায় কবরের উপর? মূলত শুধুমাত্র একটি কাজই করা যেতে পারে, আর তা হলো- মানুষকে ধোঁকা দেয়ার কৌশলাদি সাজিয়ে বসে দিনে দুপুরে লোকদেরকে মোহাচ্ছান্ন করে প্রকাশ্য ডাকাতির কাজটাই করা যেতে পারে শুধুমাত্র। অন্যথা জাগতিক সকল কাজের জন্য এই পৃথিবী অনেক বিস্তৃত, এবং মানুষ সেজন্য অনেক সুবিধা সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রপূর্ণ অফিস-আদালত, কল-কারখানা, বাজার ইত্যাদি নির্মাণ করেছে।

ইবাদাতের জন্য মানুষ গৃহ নির্মাণ করে থাকে: অথচ কবরবাসীর নিজের আর কোন ইবাদাত করার বিন্দুমাত্র সুযোগও নেই। যে নেই, সে কিভাবে ইবাদাত করবে? তাহলে ইবাদাত গৃহ কার জন্য? অবশ্যই জীবিতদের জন্য। তারাইবা কার উদ্দেশ্যে ইবাদাত করবে? আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদাত করার জন্য তো মসজিদ সমূহ রয়েছেই এবং সেগুলো অবশ্যই কবরের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়। তাহলে অর্থ কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, কবরের উপরে নির্মিত মসজিদের ইবাদাতে কবর বাসীর উদ্দেশ্যেও কোন না কোনভাবে কিছু ইবাদাত নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে কিংবা পুরোটাই। মূলত উপরোল্লেখিত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অধ্যায়ে কবরের উপরে বসা ও তাতে ইবাদাত করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অতএব, যারা কবরের উপর ইবাদাতের জন্য গৃহ নির্মাণ করে থাকে, তারা নিঃসন্দেহে জাহেল বা মূর্খ, গোমরাহ্ বা বিভ্রান্ত, এরা আল্লাহর প্রকৃত দ্বীন ইসলামের দুশমন, কেননা এদের মাধ্যমেই মানুষেরা প্রকৃত-সত্য দ্বীন থেকে বহুদূরে ছিটকে পড়ে। এরাই মানুষকে জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করায় এভাবে কবরের উপর মাজার প্রতিষ্ঠা ও তাতে ইবাদাত করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে।

সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক যে, কবরের উপর দেয়াল বা প্রাসাদ কেন নির্মাণ করা হয়:
কারণ মূলত দু’টো- ১) ইবাদাত, ২) ব্যবসা ও ৩) সংরক্ষণ।
১) ইবাদাত: একটা গোষ্ঠী আছে যারা অতিভক্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধার সাথে সাথে শয়তান কর্তৃক প্ররোচণায় নিপতিত হয়ে নিজেদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের ভাস্কর্য নির্মাণ করতে শুরু করে, তারপর পর্যায়ক্রমে তাতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করে, তারপর ঘরে ঘরে তা স্থাপন করে এবং অবশেষে শয়তান তাদেরকে দিয়ে ঐসব ভাস্কর্য তথা মূর্তির পায়ে কিংবা বেদীতে আন্তরিক, নযর-মান্নত এমনকি মস্তক নোয়ানো বা সিজদা করার মত ইবাদাত আদায় করতে সক্ষম হয়। ইসলাম যাকে সুস্পষ্টভাবে বড় শির্ক বলে আখ্যায়িত করেছে এবং যার পরিণতি আক্বীদা-বিশ্বাসে ব্যক্তি ইসলামের সীমানা থেকে বহিস্কার হয়ে যায়, সমাজে তার নাম আব্দুর রহমান কিংবা বদর উদ্দীন যাই হোক না কেন।

২) ব্যবসা: সমাজের কিছু ধূরন্ধর মানুষেরা যখন উপরোল্লেখিত মূর্খ ও বিভ্রান্ত একটা গোষ্ঠীর সন্ধান পেয়ে যায়, তখন শয়তানের চক্রান্তে ও প্ররোচণায় তাদের মাথায় ব্যবসায়ী একটা চিন্তা খেলে যায়। তারা তখন শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী ব্যবসার কাঠামো সাজিয়ে ফেলে এবং মাজার দখল করে বসে। এজন্য দেখবেন প্রত্যেক মাজারে খাদেম রয়েছে, কি কাজ খাদেমের? মৃত ব্যক্তি কি খেদমত নেন তার কাছ থেকে? সে মূলত জীবিত লোকদের চোখে ধোঁয়ার সৃষ্টির খেদমত আঞ্জাম দিয়ে থাকে, সে মূলত মোহ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে অর্থকড়ি খসানোর খেদমত(?) আঞ্জাম দিয়ে থাকে। তারপর গভীর রাতে তাদের নিজস্ব অংশীদারদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে। এছাড়া যারা শক্তি ও বুদ্ধির দুর্বলতার জন্য বড় বড় মাজারের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না কিংবা বিতাড়িত হয়, তারা তখন হয় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, অমুক সড়ক পথের ধারে তমুক বাবার কবর, কিংবা মাটি উঁচু করে তাতে লালশালু বিছিয়ে বসে যায় ডাকাতির ধান্ধায়। আর এতে তাদের একমাত্র পুঁজি হলো মানুষের ধর্মপ্রীতি, তবে অবশ্যই স্বল্পজ্ঞান ও অজ্ঞান মানুষদেরই কেবল; জ্ঞানী ও দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষিতদের দ্বীনপ্রীতি নয় এবং নিজেদের অতি উর্বর মস্তিষ্ক।

৩) সংরক্ষণ: একথা ঠিক যে, অনেকেই প্রিয়জনদের কবরকে সংরক্ষণ করার জন্য কবরের চারপাশে দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করে থাকেন। নিয়ত ঠিক থাকলেও শরীয়ত-পরিপন্থী হওয়ার কারণে এটাও বর্জনীয়। যুক্তি তর্কে গেলে অনেক কথাই বলা যায় যে, পৃথিবীর আদি থেকে যদি মৃতদের কবরগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে সংরক্ষণ করার জন্য দেয়াল দেয়া চলতে থাকতো, তবে পৃথিবীতে হয়ত জীবিতদের থাকার জন্য ঘর নির্মাণ করার মত কোন জায়গা থাকতো না। বরং সেদিকে না গিয়ে আমাদের দেখতে হবে যে, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে কী দিকনির্দেশনা দান করেছেন আমাদেরকে। তিনি একবার আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে প্রেরণ করেন এই বলে যে, মদীনার সকল উঁচু কবরগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে আস; তিনি তাই করলেন। এ ব্যাপারে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ভাষ্য হলো: ((তিনি (আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আবুল হাইয়াজ আল আসাদীকে বলেছিলেন ‘আমি কি তোমাকে এ জন্য পাঠাবো না যে জন্য আমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠিয়েছিলেন?)) সুতরাং আলাদা দেয়াল অথবা প্রাসাদ নির্মাণের তো কোন প্রশ্নই আসে না; বরং কবরকে দীর্ঘদিন অতিরিক্ত উঁচু করে রাখাও সঠিক পন্থা নয়। তাই উচিত হবে সম্পূর্ণ কবরস্থানকে ঘিরে দেয়াল অথবা বেড়া করে দেয়া যাতে গবাদি পশু ও অন্যান্য সকল প্রকার অনিষ্টতা থেকে কবরগুলোকে রক্ষা করা যায়। এটাই সঠিক ও উত্তম পন্থা।

অতএব, বিস্তারিত আলোচনা থেকে এটাই সুস্পষ্ট হলো যে, কবরের উপর দেয়াল নির্মাণ, প্রাসাদ নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, কবরকে ঈদগাহ বা উৎসবের স্থান বানানো, কবরের উপরে বসা, কবরের প্রতি সালাত আদায় করা, নযর-মান্নত করা, মোমবাতি দেয়া, দূর-দূরান্ত থেকে সেদিকে সফর করা, কবরে রাখা লালশালু ঢাকা মটকায় অর্থকড়ি দান করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড সুস্পস্ট শির্ক বা আল্লাহর সাথে অংশীবাদ, জাহেলী বা মূর্খতা, দ্বলাল বা গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা এবং কুসংস্কারও বটে।

পরিশেষে: মুসলমানদের কবর পবিত্র রাখার স্থান, তাই সংরক্ষণ করা ভাল এবং প্রয়োজনও কিন্তু তা আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকটি কবরে দেয়াল তুলে নয়; বরং পুরো কবরস্থানকে ঘিরে অপচয়হীন দেয়াল তুলে দেয়া যেতে পারে যাতে প্রাণীকুল কিংবা দুষ্ট লোকেরা সেখানে কোনরূপ খারাপ কিছু সংঘটিত করতে না পারে। তদ্রূপ কবর যিয়ারত করা যেতে পারে যেভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন- আখেরাতের ভাবনা জাগরিত করার জন্য এবং সঠিক পন্থায় সঠিক দো’আ পড়ার মাধ্যমে; কমও নয় বেশীও নয়। তাতেই যাবতীয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে আমাদের জন্য। অন্যথা হলে তা কোন না কোনভাবে শির্ক, বিদ’আত কিংবা ভ্রস্টতার পর্যায়ে যেতে বাধ্য! তাই আসুন, কবর ও কবরবাসীদের ব্যাপারে সাবধান হই। তাদেরকে তাদের যথাযথ অবস্থান দান করার মাধ্যমে কবরবাসীকেও নিষ্কলুষ রাখি এবং নিজেরাও নিরাপদ থাকি শির্ক থেকে, গোমরাহী থেকে ও কুসংস্কার থেকে, এমনকি অর্থকড়ির অপচয়মূলক জাগতিক ক্ষতি থেকেও। যেমনটি আল্লাহ্ আমাদের সম্পর্কে বলেছেন: ((তাদেরকে এ ছাড়া অন্য কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত আদায় করবে; এটাই সঠিক দ্বীন।)) [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ: ৫] আল্লাহ্ তা’আলাই একমাত্র তৌফিক দাতা।
২৯.০৮.২০০৭, মদীনা মুনাওয়ারা, সৌদি আরব।.