জিজ্ঞাসা ও জবাব (৪৬-৫১)

Print
Category: জিজ্ঞাসা ও জবাব
Published Date Written by ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

প্রশ্ন ৪৬: দেশের একটি ইসলামি ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে আমার ৪ লক্ষ টাকার ১০ বছর মেয়াদি একটি বীমা আছে, ইতোমধ্যে গত ৮ বছরে আমি তাদের প্রায় ৩ লক্ষ টাকা পরিশোধ করেছি, আগামী দু’বছরে বাকি ১ লক্ষ টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে ৩য় বছরের মাথায় গিয়ে আমার বীমার টাকা লাভসহ পাবার কথা। এখন পরিশোধিত মূলধনের যাকাত দিতে হবে কিনা? এ বিনিয়োগের কোন টাকার উপরই কি আমার প্রকৃত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত আছে?

উত্তর: ইসলাম ইন্সুরেন্সগুলোর লাভ-লোকসান সন্দেহজনক। তবে এটা ঠিক যে, আপনি যে টাকা পরিশোধ করেছেন তা আপনার নিজস্ব টাকা। সেটার উপর যাকাত আসবে। যদি সে টাকা নিসাব পরিমাণ হয়ে থাকে, তবেই কেবল তাতে যাকাত আসবে। নতুবা নয়।

প্রশ্ন ৪৭: পাগলের উপর যাকাত ফরদ্ব কি না? পাগলের সম্পদের তো কেউ না কেউ অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক থাকে। সেক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ককে পাগলের পক্ষ হতে তার সম্পদ হতে যাকাত আদায় করতে হবে কি না?

উত্তর: পাগল ও বাচ্চার সম্পদের উপর ইমাম আবু হানিফার মতে যাকাত নেই। তবে অন্যান্য ইমামদের নিকট তাদের সম্পদেও যাকাত আছে। তার তত্ত্বাবধায়ক সেটা থেকে যাকাত আদায় করে দিবে। আর এটাই অধিক শক্তিশালী মত।

প্রশ্ন ৪৮: ব্যবহারিক স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপর যাকাত ফরদ্ব কি না? কি পরিমাণ অলংকার ব্যবহারিক হিসেবে ধর্তব্য হবে? ব্যবহারিক অলংকার সহ যদি নেসাব পূর্ণ হয়, তাহলে কি সে হিসেবে যাকাত দিতে হবে? আর যদি ব্যবহারিক অলংকার বাদ দেয়ার পর এমন পরিমাণ অলংকার থাকে যাতে নেসাব পূর্ণ হয় না, তাহলে কি ঐ অতিরিক্ত অলংকারের উপর কোনভাবে যাকাত আসবে?

উত্তর: সে অলংকারই ব্যবহারিক অলঙ্কার বলে বিবেচিত হবে যা বেশির ভাগ সময় পরা হয়। আর যদি মাঝে মধ্যে বছরে বা কালে-ভদ্রে কোনো অলঙ্কার ব্যবহার করে থাকে,ার তবে সেটা ব্যবহারিক অলংকার নয়।
সুতরাং যে সকল অলঙ্কার সম্পদ হিসেবে রাখবে, তা নেসাব পরিমান হলে যাকাত দিতে হবে।
আর যে সকল অলঙ্কার অধিকাংশ সময় পরিধান করা হয়, সেটাতে অধিকাংশ আলেমের নিকট যাকাত নেই। ইমাম আবু হানিফা ও বর্তমান সময়ে শাইখ ইবন বায, শাইখ উসাইমীন সেটাতেও যাকাত দিতে হবে বলেছেন।
তাই যদি আপনি মনে করেন যে, ব্যবহার্য স্বর্ণের যাকাত দেওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত, তবে আপনাকে ব্যবহারিক ও অব্যবহারিক সবগুলো মিলিয়ে নেসাব হলে সেটার যাকাত দিতে হবে। আর যদি মনে করেন যে, ব্যবহারিক স্বর্ণের যাকাত দেওয়া লাগবে না, তবে  সেটা বাদ দিয়ে নেসাব পূর্ণ না হলে আপনার উপর যাকাত নেই।
এ মাসআলায় দু’টি মত যেহেতু রয়েছে, সেহেতু আপনার দ্বীনদারীর উপর ছেড়ে দেওয়া হলো। যদিও আমি মনে করি, ব্যবহার্য ও অব্যবহার্য সকল সম্পদেরই যাকাত দিতে হয়। আর এটাই বেশী শক্তিশালী অভিমত।

প্রশ্ন ৪৯: ব্যবসার পুঁজি বা সরঞ্জামের উপর যাকাত ফরদ্ব হবে কি না? হলে তার কোন পরিমাণ নির্ধারিত আছে কি? অথবা সরঞ্জামেরই বা কোন সীমা পরিসীমা আছে কি? দয়া করে জানাবেন। তেমনিভাবে যদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে জমি কিনে রাখা হয় অর্থাৎ, জমি কেনাবেচার ব্যবসা, তাহলে কি সে জমির উপর যাকাত ফরদ্ব হবে? আর যদি একটা জমি শুরুতে নিজের বাড়ী তৈরীর জন্য কেনা হলো, বেশ ক'বছর পরে দেখলে যে, ভালোই দাম উঠেছে, তাই বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করলো। এক্ষেত্রে জমির উপর যাকাত ফরদ্ব হবে? হলে কিভাবে আদায় করতে হবে?

উত্তর: ব্যবসার পুঁজি ও লাভ উভয়টিরই যাকাত দিতে হবে। যদি না সেটা সরঞ্জাম হয়ে যায়। ধরুন আপনার কাছে দশ লক্ষ টাকার পুঁজি রয়েছে, আর আপনার লাভ হয়েছে, দুল লক্ষ্ টাকা, এমতাবস্থায় আপনাকে দু’টিরই যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যদি পুঁজি অন্য কিছুতে পরিণত হয়ে যায়, যেমন আপনি যদি দশ লক্ষ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছেন ভাড়া দেওয়ার জন্য, তখন আপনার উপর শুধু ভাড়ার টাকার উপর যাকাত আসবে, যদি সেটা নেসাব পরিমাণ হয়। অনুরূপভাবে দোকানে যদি দশ লক্ষ টাকা খরচ করে ডেকোরেশন বা বিল্ডিং তোলে থাকেন, তবে সেটার যাকাত আসবে না, শুধু লাভের উপর আসবে, যখন লাভ নেসাব পরিমান হবে। তদ্রূপ কল-কারখানায় যদি ২০ লাখ টাকা দিয়ে কল-কবজা কিনে থাকেন, তবে সেটার উপর যাকাত আসবে না, আসবে শুধু লাভের উপর ।
কিন্তু যদি সেটা টাকা হিসেবে থাকে যেমন আপনি দশ লক্ষ টাকার পুঁজি দিয়ে কাপড়ের দোকানে কাপড় উঠালেন, তখন দশ লক্ষ+লাভ পুরোটার উপরই যাকাত আসবে।
মনে রাখবেন, ব্যবাসয়ী সরঞ্জামের কোনো সীমা নেই।
যে জমি ব্যবসার জন্য খরিদ করা হয়েছে সে জমিনের উপর যাকাত আসবে। আর যে জমি বাড়ী করার জন্য খরিদ করা হয়েছে সে জমিনের উপর যাকাত আসবে না। এমনকি যদি লাভ দেখলে পরবর্তীতে বিক্রয় করাও হয়, তবুও তাতে যাকাত আসবে না। অবশ্য বিক্রি করার পর নেসাব পরিমাণ হলে এবং বছর পূর্ণ হলে সে টাকাতে যাকাত আসবে।

প্রশ্ন ৫০: উমরী কাদ্বা নামে কোন নামায আছে কি? যদি থাকে তাহলে তার তাহলে তার দলীল প্রমাণ জানাবেন। এবং আদায়ের পদ্ধতিও জানাবেন। আর না থাকলে এ নামযের উদ্ভব কিভাবে হলো জানিয়ে বাধিত করবেন। এবং বিগত দিনে আদায় না করা নামাযগুলোর জন্য করণীয় কি?

উত্তর: উমরী কাযা বলতে কোনো নামায নেই। সুতরাং সেটার পদ্ধতিও নেই। কিছু কিছু মানুষ রোযার কাফফারার উপর কিয়াস করে নামাযের কাফফারা নির্ধারণ করেছেন। অথচ এটা ভুল। কারণ;
* যে নামায পড়ে না সে ঈমানদার নয়। বেঈমানের কাছ থেকে কিছু্ই গ্রহণ করা হয় না।
* কাফফারার উপর কোনো কিয়াস হয় না। এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত।
* সর্বাবস্থায় নামায বাধ্যতামূলক। যদি দাঁড়িয়ে পড়তে না পারে তো বসে পড়বে, তাও না পারলে পার্শ্ব দেশে, তাও না পারলে শুয়ে চিত হয়ে, তাও না পারলে চোখের ইশারায়। সুতরাং নামায ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিগত দিনের নামায যাদের ছুটে গেছে, তারা যদি মনে রাখতে পারেন যে, তার সুনির্দিষ্ট অল্প সংখ্যক নামায ছুটে গেছে তবে সেটাকে তিনি কাযা করবেন। আর যদি জীবনের এক বিরাট সময় তিনি নামায আদায় না করে থাকেন, তবে সেটার জন্য তিনি তাওবা ইস্তেগফার করবেন। আর বেশি বেশি করে নফল পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন। কারণ, তখন তিনি ঈমানদার ছিলেন না। যদি তিনি সে অবস্থায় মারা যেতেন তবে তিনি ঈমানহারা হয়ে চলে যেতেন।

প্রশ্ন ৫১: পবিত্র হাদীস শরীফে আছে, হযরত ফাতেমা(রা) তার ইন্তেকালের আগে পানি চেয়ে বলেছিলেন: আমার গোসল আমি নিজেই করবো।আমার প্রশ্ন হলো; ওনার ইন্তেকালের পর ওনাকে আবার গোসল করানো হয়েছিলো কিনা? করানো হয়ে থাকলে গোসলটা কে করিয়েছিলেন?

উত্তর: যে হাদীসে বলা হয়েছে যে ফাতেমা রা. মারা যাওয়ার আগে নিজেই গোসল করে তাকে গোসল করাতে নিষেধ করেছেন, সে হাদীসটি বিশুদ্ধ বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। ইমাম ইবনুল জাওযী, ইমাম যাহাবী, ইবন কাসীর, ইবন হাজার সহ অনেকেই বলেছেন যে এ বর্ণনাটি শুদ্ধ নয়।
বরং বিশুদ্ধ বর্ণনা হচ্ছে যে, আলী রা., আসমা বিনতে উমাইস, (আবু বকরের স্ত্রী), ফাতেমার ধাত্রী সালমা (উমমে রাফে‘) ও আব্বাস রা. এর সহযোগিতায় তাঁকে গোসল দিয়েছেন। দেখুন, মুসান্নাফ আবদির রাযযাক; ৩/৪১০; অনুরূপভাবে দারা কুতনী, মুস্তাদরাকে হাকিম, বাইহাকী, প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ যা তাদের গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
সুতরাং আপনি যা শুনেছেন তা শিয়াদের অপপ্রচার। ফাতেমা রা. ছিলেন ফকীহা, জ্ঞানী, তিনি ভালো করেই জানতেন যে, মৃত্যুর আগের গোসল মৃত্যুর পরের গোসলের জন্য যথেষ্ট নয়। সুতরাং এ জাতীয় কিছু তিনি কখনও করেন নি। শিয়ারা সব সময় মিথ্যুক। এখানেও মিথ্যাচার করে থাকে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী ফাতেমাকে গোসল দিয়েছে এ সত্যটি মানলে তাদের শত্রুতা করার আর সুযোগ থাকে না, তাই -তারা মিথ্যা কথা - তৈরী করেছে।


~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~

জীবন যতদিন আছে, জিজ্ঞাসাও ততদিন থাকবে। যত জিজ্ঞাসা আছে, তত জবাবও আছে। তবে জিজ্ঞাসা করতে হবে জ্ঞানীদের নিকট। জ্ঞানী তথা আলেম নির্বাচনই আপনার কৃতিত্ব। কুরআন ও সুন্নার বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী সত্যপন্থী আলেম আপনাকে সত্যের পথে নিয়ে যাবে। আপনার জীবনের যে কোন জিজ্ঞাসা আজই পাঠিয়ে দিন "নির্মাণ" বরাবর।
আপনার জিজ্ঞাসার জবাব দিচ্ছেন ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, পি এইচ ডি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মদীনা মুনাওয়ারা। সহকারী অধ্যাপক ও ফিকাহ্ বিভাগের চেয়ারম্যান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
জিজ্ঞাসা পাঠাবার ঠিকানা: This e-mail address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~

শায়খের অন্যান্য জবাবগুলো জানতে অনুসরণ করুন: জবাব দিচ্ছেন: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

.
By Joomla 1.6 Templates and Simple WP Themes