বীর মুক্তিযোদ্ধা
তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
গোলাম মোস্তফা খান, বীর বিক্রম
৫৯২
স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।
গোলাম মোস্তফা খান, বীর বিক্রম
পাকিস্তানি পর্যবেক্ষণ পোস্ট ধ্বংস করেন
মুষলধারায় বৃষ্টি আর ঘোর অন্ধকারের মধ্যে গোলাম মোস্তফা খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা ছিলেন দুটি দল (কোম্পানি) এবং কয়েকটি উপদলে (প্লাটুন ও সেকশন) বিভক্ত। তাঁদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্তঘাঁটি আক্রমণ করে সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করা।
গোলাম মোস্তফারা নিঃশব্দে এফইউপিতে (ফর্মি আপ প্লেস) সমবেত হন। এর অদূরেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি। তাঁদের সমন্বিত আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষায় ফাটল ধরে। এর পর পাকিস্তানিরা দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইনের শেলপ্রুফ বাংকারে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইনের বাইরে একটি গাছের ওপর ছিল তাদের সুরক্ষিত গোপন পর্যবেক্ষণ পোস্ট। সেখান থেকে দু-তিন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে বাংকারে খবর পাঠায়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানিরা গোলাবর্ষণ করে। এটা গোলাম মোস্তফা খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে বুঝতে পারেননি। তাঁদের এক সহযোদ্ধা সেটি দেখতে পেয়ে তাঁকে জানান।
গোলাম মোস্তফা খানের কাছে ছিল এলএমজি। তিনি এলএমজি নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পর্যবেক্ষণ পোস্টের কাছে যান এবং আক্রমণ করেন। তাঁর এলএমজির ব্রাশফায়ারে পর্যবেক্ষণ পোস্ট ধ্বংস ও পাকিস্তানি সেনারা নিহত হয়। এর ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা কমে যায়।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কামালপুরে। জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। চারপাশে ছিল বাংকার। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ছিল ঘাঁটি। বিছানো ছিল অসংখ্য মাইন ও বুবিট্র্যাপ। এ ছাড়া কয়েকটি গাছের ওপরে ছিল তাদের পর্যবেক্ষণ পোস্ট।
সেদিন যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতা সাহসিকতার সঙ্গে পার হয়ে মূল প্রতিরক্ষায় ঢুকে যান। গোলাম মোস্তফা খানের অনেক সহযোদ্ধা মাইন ও গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এর পরও তাঁরা থেমে যাননি। দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় প্রতিশোধের নেশায় এগিয়ে যান। অবশ্য বিজয়ী হতে পারেননি। হেরে গিয়েও দেশমাতৃকার ভালোবাসায় জয়ী তাঁরা।
গোলাম মোস্তফা খান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে। কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানে। ১৯৭০ সালের শেষ থেকে ছুটিতে ছিলেন। মার্চ মাসের মাঝামাঝি ছুটি শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানে যাওয়ার অপেক্ষায় ঢাকা সেনানিবাসের ট্রানজিট ক্যাম্পে ছিলেন।
২৫ মার্চের পর আটক করা হয় তাঁকে। কিছুদিন পর পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁকেসহ আটক আরও অনেক বাঙালি সেনাদের ট্রেনযোগে রংপুর সেনানিবাসে পাঠায়। পথিমধ্যে এক স্টেশনে ট্রেন বিরতি দিলে তিনিসহ কয়েকজন প্রহরারত পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান। পরে জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর ‘জেড’ ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য গোলাম মোস্তফা খানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭২। গেজেটে নাম গোলাম মোস্তফা কামাল এবং যুদ্ধে শহীদ। এ সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গেজেটে ভুল করে তাঁকে শহীদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আসলে তিনি জীবিত।
গোলাম মোস্তফা খানের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার কুটি গ্রামে। বর্তমানে নিজ গ্রামেই বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম গোলাম পাঞ্জত আলী, মা রাহেলা খাতুন। স্ত্রী জ্যোস্না বেগম। তাঁর পাঁচ মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: গোলাম মোস্তফা খান বীর বিক্রমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি মো. সোহরাব হোসেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
পাঠকের মন্তব্য
- শুক্র
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
Mohamed S Rahman
২০১২.১২.১০ ২১:৪০