রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৪

আমাদের নবারুণদা ...

।।স্মরণ।।

আমাদের নবারুণদা ...

নীহারুল ইসলাম

১৯৯৯ সালে ‘হারবার্ট’ উপন্যাসের মাধ্যমে পরিচয় ঘটলেও নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার প্রথম ব্যক্তিগত আলাপ হয় ২০০৬ সালে। তাঁর সম্পাদিত সর্বভারতীয় পত্রিকা ‘ভাষাবন্ধন’-এ আমি একটি গল্প পাঠিাই। ‘মুনির ফকিরের পাঁচ ওয়াক্ত’। গল্পটি তাঁর পছন্দ হয়। এবং সেটি তিনি ছাপেন তাঁর পত্রিকায়। আর আমাকে দেখা করতে বলেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি ২০০৭-এর কলকাতা পুস্তকমেলায়। সেই শুরু, তারপর তাঁর মৃত্যুর মাসখানেক আগে শেষবারের মতো ফোনে কথা।


মধ্যের আট বছরে অনেক কথা অনেক স্মৃতি জমে আছে। সব বলা সম্ভব নয়। যেমন বলা সম্ভব নয়- লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য কখন কীভাবে আমার দাদা-বন্ধু হয়ে ওঠেন। যাইহোক, প্রথম গল্প ছাপার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন, ভাষাবন্ধন-এর বছরে দশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ওই দশটি সংখ্যার অন্তত একটিতে তোর গল্প চাই। মনে রাখিস!

আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে।

তারপর ২০০৭ বাদ দিলে প্রতি বছর একটি করে, শুধুমাত্র ২০১২-তে দুটি গল্প প্রকাশিত হয়। (১। মুনির ফকিরের পাঁচ ওয়াক্ত, মার্চ ২০০৬; ২। বুরাক কিংবা পুস্পক রথ, জুন ২০০৮; ৩। আকারপুকুর ও জলপরি, উৎসব ২০০৯; ৪। জয়নব বেওয়ার কোরবানি, নভেম্বর ২০১০; ৫। জমিল খুব বাজে ছেলে, উৎসব ২০১১; ৬। জাল খোয়াব, মে ২০১২; ৭। ঈমামসাহেব, উৎসব ২০১২; ৮। ঘূর্ণি, জুন ২০১৩) যদিও ‘ভাষাবন্ধন’ শেষপর্যন্ত মাসিক থেকে ত্রৈমাসিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। তবুও আট বছরে আমার আটটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। সেটা যতটা না আমার মনে রাখার কারণে, তার চেয়ে বেশী নবারুণদার ফোনে তাগাদার কারণে।

গল্প বাদেও নবারুণদা আমাকে আর একটি লেখা লিখিয়েছিলেন তাঁর ভালবাসার ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকায়। এই পত্রিকায় একটি বিভাগ ছিল, ‘C/o ফুটপাত’ নামে। পুরাণো বই নিয়ে সেখানে আশ্চর্য আশ্চর্য লেখা বেরোত। নবারুণদা সেই বিভাগে আমাকে লিখতে বললেন। কিন্তু আমি কী লিখবো ঠিক বুঝতে পারছি না। শেষপর্যন্ত নবারুণদার তাগাদায় পুরণো কয়েকটি সংখ্যা থেকে ওই বিভাগের লেখাগুলো পড়ে আমাকে লিখতে হয়েছিল, ‘ফুটপাতের বই এবং আমার আব্বা’। কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের অনুবাদে ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ বইটি নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি খুব প্রশংসিত হয়েছিল। নবারুণদা নিজেও ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ওই বিভাগে আরও লিখতে বলেছিলেন বার বার। কিন্তু আমার আর লেখা হয়ে ওঠেনি। নাকি লিখেছিলাম আর একটা! লেখাটি ঠিক জমেনি বলে পাঠাই নি? নাকি পাঠিয়েছিলাম? নবারুণদার পছন্দ হয়নি বলে ছাপে নি! মনে নেই।


নবারুণদা একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, নীহারুল- আমি একবার লালগোলা গিয়েছিলাম!

আমি জিজ্ঞেস করি, কখন? কীভাবে?

আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বলেন, আমার বয়স তখন বারো বছর। ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’ সিনেমার ইউনিটের সঙ্গে। আর একবার যাবার ইচ্ছে আছে। নিয়ে যাবি?

আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ। চল- ঘুরে আসবে।

তারপর নবারুণদা এসেছিলেন আমাদের লালগোলায়। হিসেব মতো সেটা ছিল তাঁর লালগোলায় আসার পঞ্চাশ বছর পূর্তি। আমার আব্বার মৃত্যুর পর। ২০১১, মার্চ মাসে। দোলের সময়। তিনদিন ছিলেন, বউদিকে নিয়ে। পদ্মা, লালগোলার রাজবাড়ি, কালীমন্দির, ‘কোমল গান্ধার’ সিনেমার সেই দৃশ্যটি যেখানে শ্যুট হয়েছিল, শিয়ালদহ লালগোলার লাইনের শেষ প্রান্ত- বাফারের পাশে দাঁড়িয়ে নায়ক পদ্মা-পদ্মাপাড়ের ভিনদেশী গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে নায়িকা সুপ্রিয়া দেবীকে বলছে, “ওই পারেই আমার দেশের বাড়ি। ওই যে ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। এত কাছে। অথচ কোনোদিন ওখানে আমি পৌঁছতে পারব না। ওটা বিদেশ ...”। নবারুণদা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। তাঁর সামনে সেদিন পদ্মা ছিল না। ধূ ধূ বালি ছিল। তিনি কিছু ভাবছিলেন। কিংবা কিছুই ভাবেননি। হয়ত এমনি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন পদ্মার আদিগন্ত বালির চর, দূরে মেঘের মতো আবছা ভিনদেশী গ্রামগুলোকে। ওই গ্রামগুলো যদি আজও আমাদেরই থাকত! গ্রামগুলো যদি ‘বিদেশ’ না হতো! ভেবে হয়ত ঋত্বিক ঘটকের মতো কষ্ট পাচ্ছিলেন!

সেবার নবারুণদার সম্মানে আমাদের ‘খোঁজ’ পত্রিকার উদ্যোগে লালগোলা এম. এন. একাডেমী’র প্রাথমিক বিভাগে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। সেবারই সদ্য প্রয়াত আমার আব্বার নামে “রফিকুল ইসলাম স্মৃতি ‘খোঁজ’ পুরস্কার” পুরস্কার চালু করি। সবটাই হয়েছিল নবারুণদার অজান্তে। আমাদের ভয় ছিল, তিনি যদি আমাদের এই সব কান্ডকারখানা অপছন্দ করেন! কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখেছিলাম, আমাদের পাগলামি তাঁর পছন্দ হয়েছিল। তিনি সাদরে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। কিছু কথা বলেছিলেন। একেবারে তাঁর অন্তরের কথা। নিজের কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। আমরা অভিভূত হয়েছিলাম। আমাদের লালগোলা অভিভূত হয়েছিল।

গত বছর তাঁর ‘কাঙাল মালসাট’ যখন সিনেমা হয়ে প্রকাশ পেল, আমি দেখতে গিয়েছিলাম বহরমপুরের ঋত্বিক সদনে। সিনেমা দেখে বেরনোর পর আমি এতটাই ঘোর আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম যে, সঙ্গে সঙ্গে নবারুণদাকে ফোন করি, দাদা- তোমার ‘কাঙাল মালসাট’ দেখলাম! তারপর আরও কিছু বলব, সেই সুযোগ না দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ওটা আমার না, সুমনের (মুখোপাধ্যায়)।

নবারুণদা তাঁর সৃষ্টির নিয়ে এতটাই নির্মোহ ছিলেন।

বেশ কয়েক বছর পর এবার কলকাতা পুস্তকমেলায় নবারুণদাকে পাইনি। তবে তাঁর শরীরে মারণরোগ বাসা বেঁধেছে খবরটা পেয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস হয়নি। তৎক্ষণাৎ আমি তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ- ঠিক শুনেছিস। আমি এখন মুম্বাইয়ে। চিকিৎসা চলছে।

তারপর মধ্যে কিছুদিন আমি আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যোগাযোগ রাখতে পারিনি। মা সুস্থ হয়ে উঠলে ফোন করি এই সেদিন, তাঁর মৃত্যুর দিন বিশ-পঁচিশ কি মাসখানেক আগে। বললেন, বল! জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছো? বললেন, আমি ভালো আছি- নবারুণ ভালো নেই।

নবারুণদার সঙ্গে আমার শেষ কথা। এখনও কানে বাজছে। বিশ্বাস করতে পারছি না নবারুণদা নেই! আর কোনও দিন তাঁর সঙ্গ পাব না! তাঁর কন্ঠ শুনতে পাব না!

1 টি মন্তব্য: