kalerkantho

মঙ্গলবার। ১৮ জুন ২০১৯। ৪ আষাঢ় ১৪২৬। ১৪ শাওয়াল ১৪৪০

নতুন সাজে শরীয়তপুর স্টেডিয়াম

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ | পড়া যাবে ৭ মিনিটে



নতুন সাজে শরীয়তপুর স্টেডিয়াম

শরীয়তপুর জেলা স্টেডিয়াম ছবি : আব্দুল আজিজ শিশির

ব্রিটিশবিরোধী তথা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহর নামেই নামকরণ শরীয়তপুরের। ঐতিহ্যবাহী এই জেলার নড়িয়া উপজেলায় ভোজেশ্বর ইউনিয়নে পাওয়া গেছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ। এখানকার সুরেশ্বর দরবার শরীফ, বুড়ির হাট মসজিদ, রুদ্রকর মঠ মন কাড়বে অনেকের। তবে ক্রীড়াঙ্গনে মনকাড়ার মতো ব্যাপার নেই খুব বেশি। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছিলেন মোহাম্মদ রকিব। এরপর জাতীয় দল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি আর কেউ। ফুটবলে তবু একজন আছেন, ক্রিকেটে নেই সেটাও। অনূর্ধ্ব-১৯ দল পর্যন্ত খেলেছেন কেবল নাহিদ হাসান। ক্রীড়াঙ্গনে একটা সময় স্থবিরতা নেমে আসাই এর কারণ। তবে আশার কথা, গত কয়েক বছর ধরে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল আর ব্যাডমিন্টন হচ্ছে নিয়মিত। মেলার বদলে খেলায় মুখর থাকছে স্টেডিয়াম।

শরীয়তপুর দেশের ৬৪তম জেলা। ২০১২ সালেও শিক্ষার হারেও তারা ছিল সবচেয়ে পিছিয়ে (তখন ছিল ৩৫ শতাংশ, এখন সেটা বেড়ে ৬৫ শতাংশ)।

নড়িয়া উপজেলার অর্ধলাখের বেশি মানুষ ইতালিপ্রবাসী। পুরো জেলার দেড় লাখেরও বেশি মানুষ থাকে ইতালিতে।

নড়িয়া থেকে প্রচুর রেমিট্যান্স আসায় সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিস্মিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘নড়িয়া জায়গাটা সিলেটের কোথায়?’ পরে শরীয়তপুরে জানতে পেরে অবাক হন তিনি। শুধু নড়িয়া নয়, এই জেলার অন্যান্য উপজেলার মানুষও ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকেন জীবিকার তাগিদে। তাঁদের ছেলেমেয়েদের হাতে তাই প্রচুর টাকা। তাই তারা সেভাবে স্কুল-কলেজে যায় না, পাওয়া যায় না খেলার মাঠেও। এ নিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালামের আক্ষেপ, ‘এটা বড় একটা সমস্যা আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে। তরুণরা খেলার মাঠে আসছে না, এর চেয়ে হতাশার কী হতে পারে! পাশাপাশি তেমন পৃষ্ঠপোষকতাও পাই না আমরা। তাই ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টনের বাইরে অন্য খেলাগুলো করি টাকা জোগাড় হওয়ার পরই।’

এই জেলার বিসিবি ও বাফুফের কাউন্সিলর মোজাম্মেল হক চঞ্চল। দৈনিক যুগান্তরের এই সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় স্কয়ারের মতো বড় গ্রুপের কর্ণধার অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন বহুবার। স্পন্সর করেছেন জেলার কয়েকটি খেলা। তেমনি অ্যানভয় গ্রুপের কুতুবউদ্দিন আহমেদ, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি বশির আহমেদ মামুন, হানিফ ভূইয়া, একরামুল করিম চৌধুরী, ইউসুফ আলীর মতো ক্রীড়া অন্তপ্রাণ সংগঠকরাও নানাভাবে সাহায্য করেছেন শরীয়তপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে। এ জন্য মোজাম্মেল হোসেন চঞ্চলের প্রতি শরীয়তপুর ক্রিকেট একাডেমির সভাপতি দুলাল খানের কৃতজ্ঞতা, ‘আমরা আসলে চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে থাকি। কখন ও স্পন্সর জোগাড় করবে আর কখন খেলার আয়োজন করব আমরা।’

শরীয়তপুর শহরের ধানুকায় ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জেলা স্টেডিয়ামটি। দীর্ঘদিন উন্নয়ন না হওয়ায় বেহাল দশা হয়েছিল স্টেডিয়ামটির। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি দ্বিতল ভবন, ২০০ ফুট গ্যালারি ও নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে নতুন সাজে সাজানো হয়েছে জেলা স্টেডিয়াম। এর নাম এখন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ লে. নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ স্টেডিয়াম।

একটা সময় মেলা আর সার্কাসের নিয়মিত ভেন্যু ছিল জেলা স্টেডিয়াম। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই চিত্র বদলেছে। এ নিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম জানালেন, ‘স্টেডিয়াম খেলার জায়গা, মেলার নয়। ক্রীড়াঙ্গনে খেলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে কিছু দিন আগে ট্রান্সফার হওয়া জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি রামচন্দ্র দাসের। এখানে ফুটবল ম্যাচগুলোয় দর্শকদের জায়গা দিতে পারি না। তাই জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ করেছি, নতুন গ্যালারি নির্মাণের।’ সেই নতুন গ্যালারির ওয়ার্ক অর্ডারও হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তৈরি হতে যাচ্ছে আরো ১০০ ফুট গ্যালারি। তবে পরিচ্ছন্ন স্টেডিয়ামটিতে কোনো দোকান না থাকায় আয়ের উৎস নেই জেলা ক্রীড়া সংস্থার। সেই সঙ্গে এই জেলা ক্রীড়া সংস্থার অনুমোদন নেই হাউজি পরিচালনারও।

স্টেডিয়াম হওয়ার আগে কুলসা স্কুলের মাঠ আর পালং উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ মুখর থাকত খেলায়। মাঠ দুটির এখন বেহাল দশা। কলেজ মাঠেও পানি ওঠে বর্ষায়। তবে এখনো খেলার উপযোগী আছে মাঠটা।

জেলা প্রশাসক গোল্ড কাপ বেশ জমজমাটভাবেই হয় শরীয়তপুরে। স্থানীয় দলগুলোর পাশাপাশি খেলতে আসে দেশের নানা প্রান্তের ক্লাব। সর্বশেষ গত বছর অষ্টম আসরে খেলতে এসেছিল ঢাকা ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাব, গোপালগঞ্জ আবাহনী ক্রীড়া চক্র, টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমি, নারায়ণগঞ্জ বঙ্গবীর সংসদ, ঢাকা শান্ত স্পোর্টস, বরিশাল জেলা ক্রীড়া সংস্থা, বরগুনা জেলা ক্রীড়া সংস্থা, পটুয়াখালী জেলা ক্রীড়া সংস্থা, মাদারীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা, কুষ্টিয়া একাদশ ও বাসাবো তরুণ সংঘ। শেষপর্যন্ত অবশ্য শিরোপা জেতে শরীয়তপুর জেলা একাদশ। ফাইনালে তারা নড়িয়া কিশলয় ফুটবল একাডেমিকে হারায় ২-০ গোলে। সপ্তম জেলা প্রশাসক গোল্ড কাপের ফাইনালে বেধেছিল আবার লঙ্কাকাণ্ড। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বরিশাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ও শরীয়তপুর আব্দুর রব মুন্সী ক্রীড়াচক্র। প্রথমে এগিয়ে যেতে পারত শরীয়তপুর আব্দুর রব মুন্সী ক্রীড়াচক্র। কিন্তু বল জালে জড়ালেও বরিশাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের গোলকিপারের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল স্থানীয় ক্লাবের এক খেলোয়াড়ের। রেফারি গোল না দিয়ে ফাউলের বাঁশি বাজালে আব্দুর রব মুন্সী ক্রীড়াচক্রের সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পরে পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে পুলিশ ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। নাহিদুর রহমান নামে এক পুলিশ সদস্যও আহত হন তাতে। গুরুতর আহত আব্দুর রব মুন্সী ক্রীড়াচক্রের টিম ম্যানেজার সুমন বেপারীকে ভর্তি হতে হয়েছিল শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে। ফুটবল নিয়ে এমন উন্মাদনা আছে বলেই জেলা প্রশাসক গোল্ড কাপটা এমন জমজমাট হয় শরীয়তপুরে। পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয় আন্ত-উপজেলা ফুটবল লিগও। এখানে আবার বাইরের দলগুলোর সুযোগ নেই। অংশ নেয় স্থানীয় উপজেলাগুলোর ফুটবল দল।

ক্রিকেট মোটামুটি নিয়মিত শরীয়তপুরে। গত ১৫ বছরে সব লিগই হয়েছে এমন নয়। তবে লম্বা সময়ের জন্য বন্ধও থাকেনি লিগ। লেভেল টু করা জেলা দলের কোচ সেলিম সিকদার জানালেন, ‘আমাদের এখানে স্পন্সরের অভাব। ক্রিকেটের মতো খরুচে টুর্নামেন্টের জন্য টাকার বিকল্প নেই। তাই লিগগুলো অনিয়মিত ছিল। তবে গত তিন বছরের চিত্রটা আলাদা। এই তিন বছরে তিনটি লিগ করতে পেরেছি আমরা। ফুটবলের মতো এগুলোকে জমজমাট বা উত্তেজনার বলা যাবে না। তবু লিগ হচ্ছে এটাই সন্তুষ্টির।’ ক্রিকেটে বরাবরই দাপট শরীয়তপুর ক্রিকেট একাডেমির। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর লিগের বেশির ভাগ শিরোপা জিতেছে তারাই। এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েই জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন নাহিদ হাসান। অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলেছেন ইমতিয়াজ আহমেদ সীমান্ত আর অনূর্ধ্ব-১৫ দলে রাব্বি ও আজিজ। তবে বয়সভিত্তিক খেলাগুলোয় গত কয়েক বছর বলার মতো অর্জন নেই। আঞ্চলিক পর্যায়ে সেমিফাইনালের গণ্ডি পেরোতেই হিমশিম খায় তারা। অথচ একটা সময় অনূর্ধ্ব-১৩ ও অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেটে শরীয়তপুর জেলা দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক পর্যায়ে।

শরীয়তপুর জেলা স্টেডিয়ামে গত বছর মার্চে ৩৭ হাজার বর্গফুটের মানব মানচিত্রে দাঁড়িয়ে সম্মিলিতভাবে জাতীয় সংগীত ধ্বনিত হয়েছিল ১০ হাজার মানুষের কণ্ঠে। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন জেলা স্টেডিয়ামে এই কর্মসূচির আয়োজন করে। মাঠে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্রে একসঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা দাঁড়িয়ে দেশপ্রেমের চেতনা ধারণ করে সম্মিলিত কণ্ঠে গাইতে থাকেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ সেই স্মৃতি এখনো অমলিন শরীয়তপুরবাসীর হৃদয়ে।

গত বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে আইজিপি যুব কাবাডি প্রতিযোগিতা। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের ফাইনালে নাম লিখিয়েছিল ভেদরগঞ্জ থানা কাবাডি দল ও গোসাইরহাট থানা কাবাডি দল। নির্ধারিত ৫০ মিনিটে গোসাইরহাট থানা কাবাডি দল ১৫ পয়েন্টে হারায় ভেদরগঞ্জ থানা কাবাডি দলকে। বিভিন্ন থানায় প্রতিযোগিতাভিত্তিক ফুটবল, ভলিবল, হাডুডু ও ব্যাটমিন্টন খেলা হয়ে থাকে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে লালিত যে প্রতিযোগিতা এখানেও পরিদৃষ্ট হয় তা হচ্ছে নৌকাবাইচ। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে এখানে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা হয়। পৌষ ও চৈত্রসংক্রান্তিতে আগে এখানে ষাঁড়ের দৌড় হতো। ইদানীং এটা খুব একটা দেখা যায় না।

মন্তব্য