গানে ও চলচ্চিত্রে অনিবার্য সৈয়দ হক : ফরিদ আহমদ দুলাল

শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের বহুমাত্রিকতার এক উজ্জ্বল দিক তাঁর গীতি-কবিতা এবং চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টতা। বর্তমান রচনায় তাঁর চলচ্চিত্রশিল্পী ও গীতিকার চারিত্র্যটিকেই উন্মোচন করতে সচেষ্ট হবো। কবি সৈয়দ হক তাঁর যৌবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় চলচ্চিত্রশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন; এবং মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট হবার সাথে সম্পৃক্ত ছিল তাঁর যৌবনের ঘোর আর তারুণ্যের আবেগ। ষাট ও সত্তরের সামান্য সময় তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র পরিচালকের সাথে কাহিনীকার, চিত্রনাট্য-সংলাপ এবং গীত রচয়িতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল জব্বার খাঁ, কামাল আহমেদ, কাজী জহির, সুভাষ দত্ত, মহিউদ্দিন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, কামাল আহমেদ প্রমুখ চলচ্চিত্রকারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। কাহিনীকার হিসেবে তাঁর গল্পে যেমন স্বতন্ত্র স্বাদ পেতেন দর্শক, তেমনি সংলাপ রচয়িতা হিসেবেও তাঁর কাছে পাওয়া যেতো ঋজু-সাবলীল সংলাপের স্বাদ, আর গীতিকার হিসেবে তাঁর গানে পাওয়া যেতো বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের জীবনের কথকতা, পাওয়া যেতো প্রেমিক হৃদয়ের আর্তি আর তারুণ্যের চপলতা। সামান্য একটু সন্ধান করলেই পাওয়া যাবে ষাট ও সত্তর দশকের যেসব চলচ্চিত্রের সাথে সৈয়দ শামসুল হক যুক্ত ছিলেন তার সব ক’টিই কেবল দর্শকপ্রিয়তায় নয়, নানান কারণেই আলোচনার দাবি রাখে। কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘অবাঞ্ছিত’ ছবির চিত্রনাট্য-সংলাপ-গীতরচনা, ‘অধিকার’ ছবির কাহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ-গীতরচনা, ‘অনির্বাণ’ ছবির কাহিনী-চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা; কাজী জহির পরিচালিত ‘ময়নামতি ছবির কাহিনী-সংলাপ-গীতরচনা; ‘মধুমিলন’ ছবির কাহিনী-সংলাপ ও গীতরচনা; সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির কাহিনী-সংলাপ-গীতরচনা, ‘বিনিময়’ কাহিনী-সংলাপ রচনা; জব্বার আলী খাঁ পরিচালিত ‘কাঁচ কাটা হীরে’ ছবির চিত্রনাট্য-গীতরচনা; মিতা পরিচালিত ‘ক খ গ ঘ ঙ’ ছবির সংলাপ রচনার পাশাপাশি কাহিনী লেখায়ও সহায়তা প্রদান; অথবা মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির গীত রচনা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের এক উর্বর আঙিনা চলচ্চিত্র, তাঁর কাহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ ও গান। প্রধানত ষাটের দশকের প্রথমার্ধ থেকে সত্তরের প্রথমাংশে বেশ ক’টি চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ ও গীত রচনা করেছিলেন তিনি, যে ছবিগুলোকে বিদগ্ধজনেরা আজো স্বর্ণযুগের ছবি বলে উল্লেখ করেন। ‘সুতরাং’, ‘অধিকার’, ‘অনির্বাণ’, ‘বিনিময়’, ‘মধুমিলন’, ‘আলিঙ্গন’, ‘অবাঞ্ছিত’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’ তাদের অন্যতম। সৈয়দ শামসুল হক যে সব চলচ্চিত্রের কাহিনীকার তার সব ক’টিই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। গতানুগতিকতার গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিটি গল্পই দর্শকদের দিয়েছে স্বতন্ত্র স্বাদ। বিশেষত যে সময়টাতে আমাদের চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ সব ছবির গল্প ভারতীয় বাংলা ছবির গল্পের ছায়াশ্রিত, একই সময়ে তাঁর ছবির গল্প মৌলিক। যখন ভারতীয় ‘দেয়া-নেয়া’ ছবির কাহিনী ও গানের অনুকরণে এ দেশে তৈরি হচ্ছে ‘স্বরলিপি’, ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবির কাহিনীর ছায়ায় তৈরি হচ্ছে ‘দর্পচূর্ণ’, ‘জীবন-মৃত্যু’ ছবির ছায়ায় তৈরি হচ্ছে ‘প্রতিশোধ’, তৈরি হচ্ছে ‘ঢেউয়ের পরে ঢেউ’, ‘আগন্তুক’ ইত্যাদির মতো দর্শকনন্দিত সব ছবি, সেখানে ভারতীয় জনপ্রিয় সব ছবির অনুকরণে নির্মিত ছবি এবং দিলকাঁপানো পাকিস্তানি ‘দারিন্দা’, ‘নাদিরা’, ‘জোশ’, ‘আখেরি চাট্টান’, ‘মহল’, ‘জারকা’, ‘রোড টু সোয়াত’ ইত্যাদির মতো উর্দু ছবিকে মোকবেলা করে সৈয়দ হকের ভিন্ন স্বাদের গল্প জনপ্রিয়তা পায়নি? লক্ষ করুন, তাঁর গল্পের শক্তি; সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘বিনিময়’ চলচ্চিত্রে নায়িকা কবরীর মুখে একটি সংলাপ পর্যন্ত নেই, বোবা একটি মেয়ে, নায়কের সাথে নেই কোনো প্রেমদৃশ্য, কোনো মান-অভিমান; তারপরও কি ছবিটি আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়নি? অথবা কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘অধিকার’, যেখানে ছবির শুরুতেই কবরীর স্বামী মারা যায়, সমস্ত ছবি জুড়ে এক সাদা থান পরে কবরীর অভিনয়, নায়কের সাথে নেই কোনো প্রেমের দৃশ্য বা গান; তারপরও কি ‘অধিকার’ আমাদের আন্দোলিত করেনি? যদি কেউ বলেন, ‘রাজ্জাক-কবরী’ মানেই হিট, তাকে বলবো, ‘অধিকারে’ রাজ্জাক-কবরী থাকলেও ‘বিনিময়ে’ উজ্জ্বল তো নবাগত? সাধারণ একটি সামাজিক রোমান্টিক-প্রেমের ছবিতেও প্রেমকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন উচ্চতায়। ষাটের দশকের শেষদিকে তিনি ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’ নামে একটি উর্দু ছবি পরিচালনাও করেছিলেন। তাঁর লেখা গানগুলো আজো আমাদের স্মৃতিকাতর করে তোলে। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ (১৯৬৪’র ২২ এপ্রিল মুক্তিপ্রাপ্ত) চলচ্চিত্রের-

তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে

ভালোবাসবে ওগো শুধু মোরে

তাই চ¤পা বকুল করে গন্ধে আকুল

এই জ্যোৎ¯œা রাতে মনে পড়ে \

অথবা-

এই যে আকাশ এই যে বাতাস

বউ কথা কও যেন সুরে ভেসে যায়

বেলা বয়ে যায় মধুমতি গাঁয়

ওরে মন ছুটে চল চেনা ঠিকানায়…

কিংবা-

এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না

বুবুমণির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা…

অথবা-

পরানে দোলা দিলো এ কোন ভ্রমরা (২)

ও সে ফুলের বনে গুঞ্জরিয়া যায়

কী করি উপায়

বলিতে শরম লাগে \

বনের পাখি বলে হারিয়ে যাবো

আমার এ আকুলতা কেমনে জানাবো।

সুতরাং চলচ্চিত্রে সৈয়দ শামসুল হক আরো একটি কাজ করেছিলেন, বাংলার সাথে উর্দু মিলিয়ে একটি গান লিখলেন; সে সময় বাংলা চলচ্চিত্রকে পাকিস্তানের উর্দু ছবির সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে; পাশাপাশি পুরান ঢাকার সংস্কৃতিতে বাংলা-উর্দু মিশেল কাওয়ালির যে প্রচলন সেটিকেও তুলে আনলেন তিনি-

আ আ……..

দেখো পিছে আরাহা হায় মোটে খানেদার

রূপ কে রানী চোর কা রাজা সব রাহো হুঁশিয়ার

দেখো পিছে আরাহা হায় মোটে খানেদার \

এই শহরে মুখ দেখে ভাই যায় না চেনা চোর

নিজের পকেট নিজেই কেটে ভাইকে বলে চোর

আজব রঙের এই শহরে ভাই কানুন চমৎকার \

কাজী জহির পরিচালিত ‘ময়নামতি’ (১৬.৫.১৯৬৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত) চলচ্চিত্রের অমর গানগুলোর কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি- ‘ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না…’ ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়…’ ‘হায়রে টাকা তুমি সময় মত আইলা না….’ অথবা ‘ফুলের মালা পরিয়ে দিলে আমায় আপন হাতে….’; ১৯৬৯-এর ১৩ জুন মুক্তিপ্রাপ্ত কামাল আহমেদ-এর ‘অবাঞ্ছিত’ চলচ্চিত্রের-

চোখ ফেরানো যায় গো তবু মন ফিরানো যায় না

কেমন করে রাখি বেঁধে মনের খোলা আয়না \

রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি পড়ে মনের মাঝে ঐ

বৃষ্টি ভেজা মিষ্টি মেয়ে কই গো তুমি কই

কালো কেশের মেঘে ঢাকা মধুর কামনা

অমন করে তুমি তারে লুকিয়ে রেখো না

রেখো না \

আবার ১৯৬৯-এর ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আলিঙ্গন’ চলচ্চিত্রের

ঐ মেঘলাবরণ কন্যা চলে চপল চরণে

কি জানি কি আছে তাহার মনে মনে \

ঐ কাজল চোখে নীল আকাশের ছায়া দুলেছে

লাল শাড়িতে ধানের ক্ষেতে আগুন লেগেছে।

সেই রঙে(২) মন আমার সে রঙে চোখ আমার

রঙিলা এ ক্ষণে \

নদীর মতন মনটি যে তার নুপূরপাগল পা

সবুজলতা জড়িয়ে বলে একটু থেমে যা।

ইচ্ছে করে মনসরণি ভরি এ দুই চোখ

আমার যে সে মনবঁধুয়া বলুক গাঁয়ের লোক।

সে স্বপ্নে(২) মন আমার সেই স্বপ্নে চোখ আমার

রঙিলা এ ক্ষণে \

অথবা ১৯৭০-এর ৫ আগস্ট মুক্তিপ্রাপ্ত কামাল আহমেদের ‘অধিকার’ চলচ্চিত্রের

কে যেন আমায় ডাকে প্রিয় নাম ধরে

আঁখিজলে ভরে চোখ তারই তরে \

অথবা-

কোন লজ্জায় ফুল সুন্দর হলো

আমি শুধাই তারে ভালোবাসার গল্প আমায় বলো \

আধো ফোটা ভীরু কলি শোনো গো বলি

ছিলাম একাকী আমি তোমার বনে

মরমের পথ ধরে বন্ধু তুমি

ভালোবাসা নিয়ে এলে আমার মনে।

বুঝিনি তো কি হতে যে কি হয়ে গেল \

কিংবা, ‘শোনো বলি একটি কথা আজ/মন দেয়া মন নেয়া সে যে বড়ই কঠিন কাজ…’ অথবা-

ও … লগ্ন যে বয়ে যায় যৌবন চঞ্চল হায়

মিলনের তৃষ্ণায় আয় রে আয় এ মধু জোছনায়

আঁখি তোরে চায় চায় চায়

বাঁধি তোরে আয় আয় আয় \

চিরদিন থাকবে না (২) এই যে সময়

গাহিবে না গুনগুন (২) কাল এ হৃদয়।

মিছে তোর সংকোচ সংকট ভয়

মন তারে দেয়া ভালো মন যারে চায় \

অথবা ১৯৭০-এ মুক্তিপ্রাপ্ত কাজী জহিরের ‘মধুমিলন’ চলচ্চিত্রের গান-

শোনো কথা শোনো ওগো প্রিয়তম

আড়ালে থেকো না তুমি কাছে এসো \

জানো না কি তুমি ওগো অভিমানী

আমি যে তোমারই তুমি যে আমারই (২)

যারে ভালোবাসি মনে যার ছবি

হলে সে নিঠুর সহিতে না পারি (২)

যে ভালোবাসে তারে ভালোবেসো \

১৯৭০-এর ১ নভেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত আবদুল জব্বার খাঁ পরিচালিত ‘কাঁচ কাটা হীরে’ ছবির

আজ নয় কাল কাল নয় পরশু

কেউ তো আমার কথা ভাববে

নীল কাঁকনের টুং টাং বাজিয়ে

দূর থেকে হয় তো বা ডাকবে \

এমনি অনেক। পরবর্তীতে আমরা সৈয়দ হককে সেভাবে গান লিখতে দেখিনি; তবে তিনি যদি গান লেখায় মনোযোগী হতেন তাহলে বাংলার মানুষ যে তার সঙ্গীত জাদুতে ¯œাত হতে পারতো সেটি হলফ করেই বলা যায়। আশির দশকে আশীর্বাদ চলচ্চিত্রের জন্য লেখা তাঁর একটি গান যে কোনো প্রেমিক হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে-

চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা

নদীর সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা

তুমি চাঁদ হতে যদি দূরেই রয়ে যেতে

তুমি নদী হতে যদি দূরেই বয়ে যেতে

এ কথা যেন ভুলো না

তুমি যে তোমারই তুলনা \

মৃত্যুকে জয় করতে চাইলেও তিনি কিন্তু মৃত্যুর বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি, মৃত্যু সত্য স্বীকার করে লেখা তাঁর অনিন্দ্য গীতিকবিতার কথা স্মরণ করতে পারি-

হায়রে মানুষ, রঙ্গীন ফানুস

দম ফুরাইলেই ঠুস

তবুতো ভাই কারোরই নাই

একটুখানি হুশ

হায়রে মানুষ, রঙ্গীন ফানুস

রঙ্গীন ফানুস, হায়রে মানুষ \

‘বড় ভাল লোক ছিল’ চলচ্চিত্রের এ গানটির জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। প্রবীণ চলচ্চিত্রকার মহিউদ্দিন পরিচালিত এ ছবিটির বেশ ক’টি গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল খুব। আমাদের কবিদের অনেকেই গীত রচনা করেছেন, সহজেই স্মরণ করতে পারি ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কেজি মোস্তফা, জাহিদুল হক, আবিদ আনোয়ার, নাসির আহমেদ, ইকবাল আজিজ প্রমুখের নাম; আবার যারা কবি হিসেবে সে অর্থে পরিচিত নন, কিন্তু গীতিকার হিসেবে যথেষ্টই পরিচিত তারাও যে কবি নন তা-ও বলতে পারি না। খান আতাউর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মুকুল চৌধুরী, শহিদুল ইসলাম, আবদুল হাই আল হাদী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, মনিরুজ্জামান, নজরুল ইসলাম বাবু, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল; এমনি অনেক গীতিকারের গানই আমাদের মুগ্ধ করেছে। কারো কারো কোনো কোনো গান যুগ পেরিয়ে যুগান্তর হয়েছে। সহ¯্র গানের দুচার দশটি হয়তো সমকালে জনপ্রিয় হয়েছে সর্বকালের হয়েছে কম গানই। ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না/বুবুমণির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা \’ ষাটের দশকে এ গানটি এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বাংলাদেশের শহর-নগর-গ্রাম-গঞ্জ-জনপদে প্রতিটি বিয়েতেই এ গান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল; কিন্তু সাম্প্রতিককালে সে গান খুব একটা শোনা যায় না। যে অর্থে ‘তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’ গানটি চিরসবুজ হয়ে সর্বকালের হয়ে উঠেছে। গীত রচনায় সৈয়দ শামসুল হকের যে সম্ভাবনা তাকে তিনি নিজে হয়তো ততটা গুরুত্ব দেননি, গুরুত্ব দেননি বলেই সম্ভবত তিনি চলচ্চিত্র ছাড়া অন্য মাধ্যমের জন্য গীত রচনায় মনোযোগী হননি। ব্যক্তিগত জীবনে গীত রচনাকে হয়তো তিনি অর্থাগমের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যে কারণে তাঁর গানে শ্রোতারা বৈচিত্র্যের স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারপরও ‘অধিকার’ ছবির ‘শোন বলি একটি কথা আজ/মন দেয়া মন নেয়া সে যে বড়ই কঠিন কাজ’ অথবা ‘ময়নামতি’ চলচ্চিত্রের ‘হায়রে টাকা তুমি সময় মতো আইলা না’ ইত্যাদি গানে যে বৈচিত্র্য, তা কিন্তু শ্রোতা পেয়েছেন সৈয়দ হক-এর গানেই।

বৈচিত্র্য খুঁজতে প্রিয় পাঠক, তাঁর ‘বড় ভালো লোক ছিলো’ ছবির ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুশ/তবু তো ভাই কারো নাই একটুখানি হুঁশ’, গানে তিনি কী অবলীলায় আমাদের লোকজ শব্দ ব্যবহার করেছেন। যে অর্থে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গানে মানুষ বৈচিত্র্যের আস্বাদন পেতে পারেন, সে অর্থে তাঁর গানে সে আস্বাদন পাবার সুযোগ কম; রবীন্দ্রনাথ-নজরুল গানের যতটা গভীরে পৌঁছে যেতে পেরেছেন, সে চেষ্টাই হয়তো তিনি করেননি; রবীন্দ্রনাথ তো সঙ্গীতকে প্রার্থনা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, সীমার সাথে অসীমের যোগ করতে চেয়েছেন তার গানে; নজরুল গান লিখতে গিয়ে এতটাই মগ্ন হয়েছেন, যে তিনি রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে কবিতার সংশ্রব ত্যাগ করেছেন; কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক গান নিয়ে ততটা মগ্নই হননি বলা যায়। প্রধানত প্রেমসঙ্গীত ভিন্ন তাঁর অন্যমাত্রার গান খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশাত্মবোধক, পল্লীগীতি, বাউলাঙ্গ, মুর্শিদী, ভাটিয়ালী, ভক্তিগীতি, গণসঙ্গীত, প্রার্থনাসঙ্গীত, আধ্যাত্মচেতনা ইত্যাদি তাঁর গানে অনুপস্থিত; যদিও ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রের কয়েকটি আধ্যাত্ম চেতনার গান আমরা পেয়েছি। হয়তো সে কারণেই বেশকিছু লোকপ্রিয় গান লিখেও সৈয়দ শামসুল হক গীতিকার হিসেবে সর্বকালের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠেননি; তবুও আমার বিশ্বাস, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে যদি তাঁর গান নিয়মিত প্রচারিত হয়, তবে আজকের এই মিডিয়া শাসিত সময়ে তিনিও বাংলা গানে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে উঠতে পারেন। আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে সৈয়দ শামসুল হক কাহিনী-সংলাপ-গীত রচনায় অপ্রতিদ্ব›দ্বী নাম সে কথা হলফ করেই বলা যায়। অবশ্য এ কথাও সত্য বাংলাদেশের সঙ্গীতের ইতিহাস কিংবা চলচ্চিত্রের ইতিহাস যখন লেখা হবে সৈয়দ শামসুল হকের নাম নিশ্চয়ই উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়।

সাময়িকী'র আরও সংবাদ
Bhorerkagoj