নাফ যুদ্ধঃ বিডিআরের অসীম সাহসিকতার গল্প

নাফ যুদ্ধঃ বিডিআরের অসীম সাহসিকতার গল্প

বাঙালি জাতির ইতিহাস বীরত্ব ও ত্যাগের ইতিহাস। যুগে যুগে কুঁড়ে ও অলস হিসেবে খ্যাতি লাভ করা এ জাতি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, নিজেদের জীবন বাজি রেখে প্রতিপক্ষের উপর তীব্র আঘাত হানতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এ জাতি তৈরি করে দেখিয়েছে ১৯৭১ সালে। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি তখন বিশ্বের বুকে প্রমাণ করে দিয়েছিলো একতা ও সাহসিকতাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। এরপর পেরিয়ে যায় আরো প্রায় ৩০ বছর। প্রায় ৩০ বছর পর ২০০০ সালে বাংলার সাহসী বিডিআর সেনারা নাফ যুদ্ধে বার্মিজ সৈন্যদের মাধ্যমে বাঙালি জাতির বীরত্বকে আবারো তুলে ধরে বিশ্ববাসীর সামনে। আজ বলবো নিজেদের চেয়ে প্রায় দশগুন সৈন্যের বিরুদ্ধে অকুতোভয় বাঙালি বিডিআরের সেই বীরত্বের ইতিহাস।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে যখন আলাদা করা হয় তখন কোনো সীমান্ত নির্ধারণকারী রেখা নির্ধারণ করতে না পেরে নাফ নদীকেই  সীমান্ত রেখা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। নাফ নদীর অর্ধেক অংশ দেয়া হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে এবং বাকি অর্ধেকের মালিকানা দেয়া হয় বার্মা তথা মিয়ানমারকে। নাফ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে কোনরূপ বাঁধা বা পরিবর্তন করা হলে তা নদীর গতিপথকে পরিবর্তন করতে পারে যা তৎকালীন পাকিস্তান কিংবা বার্মার ভূখন্ডে পরিবর্তন সাধন করতে পারে। এই আশঙ্কার কারনে ১৯৬৬ সালে বার্মা ও তৎকালীন পাকিস্তান নাফ নদীর গতিপথ ও প্রবাহে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চুক্তি সাক্ষর করে।

Source- Twitter.com

কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ উক্ত চুক্তি মেনে চললেও বার্মা বারবার সে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। নাফ নদীতে মোট ১২টি শাখা রয়েছে যার সবগুলোই মিয়ানমারের অন্তর্ভূক্ত। মিয়ানমার উক্ত ১২ টি শাখার ১১ টি শাখাতেই বাঁধ নির্মাণ করে যার ফলে নাফ নদীর গতিপথ সরে যায় এবং তা বাংলাদেশের দিকে সরে আসে। এর ফলে প্রতিবারই বাংলাদেশের ভূখন্ডের কিছু কিছু অংশ মিয়ানমারের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। এই ১১ টি শাখার উপর বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে মিয়ানমার কৌশলে বাংলাদেশের প্রায় ২৮০০ একর ভূমি দখল করে নেয়।

১৯৯৯ সালে মিয়ানমার ১২ তম শাখাতেও বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই বাঁধটি নির্মিত হলে কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চল সম্পূর্ণভাবেই সাগরের পানিতে তলিয়ে যেত। যার ফলে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান প্রতিবাদ করেন। তিনি বারবার মিয়ানমারের কাছে এই বাঁধটি নির্মাণ না করার আহ্বান জানান। কিন্তু তার কথায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা কোনরূপ কর্ণপাতই করেনি। বরং তারা তাদের কাজ অব্যাহত রাখে। যার ফলে কিছুকাল উত্তপ্ত ভাষায় চিঠি আদান প্রদান করে দুটি দেশ। এর মধ্যে একটি চিঠিতে ইংরেজিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সরাসরি ও অশোভন ভাষায় হুমকি প্রদান করে এবং বাড়াবাড়ি করলে বাংলাদেশকে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে বলে ওই চিঠিতে জানানো হয়। বিপরীতে এর কড়া জবাব দিতে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান পরিচালক অপারেশন বিডিআর কর্নেল রফিককে নির্দেশ প্রদান করেন। উত্তরে কর্নেল রফিক মহাপরিচালককে বলেন যে হয়তো বার্মিজরা ভালো ইংরেজি জানে না, তাই হয়তো এমন চিঠি পাঠিয়েছে। তাই তিনি কড়া ভাষায় চিঠির জবাব না দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সে অনুরোধে কর্ণপাত করেন নি বিডিআর মহাপরিচালক। কর্নেল রফিকের উত্তরে বিডিআর মহাপরিচালকের উত্তর ছিল এরকম, “রফিক দেখ আমারা যেমন ব্রিটিশ রুলে ছিলাম তেমনি বার্মাও ব্রিটিশ রুলে ছিলো। আমরা যদি ইংরেজি জানতে, বুঝতে এবং ভাল লিখতে পারি তাহলে মিয়ানমারের নাসাকাও ভালো ইংরেজি লিখতে পারবে সন্দেহ নাই।” এরপর তিনি নিজেই নাসাকা বাহিনীর চিঠির জবাব প্রদান করেন। তার চিঠিটির ভাষ্য ছিল, “Excellency, the letters we receive intermittently from your HQs are worst in choice of words and construction of sentences. Often you use filthy and uncivilised words which is never written to any Forces HQs like BDR. Henceforth any such of your letters will be viewed seriously by us and you will be liable to face grime consequences. Be gentle and civilised else we will teach you lessons how to be civilised and behave properly.”

চিত্রঃ বিডিআর মহাপরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান; Source- httpsamorikbisoy.blogspot.com

আশ্চর্যজনকভাবে এরপর থেকে নাসাকা বাহিনী থেকে সবসময় যথাযথ ও মার্জিত ভাষায় চিঠি আসতো।

যাইহোক চিঠি পাঠিয়েই বসে ছিলেন না বিডিআর মহাপরিচালক। এক রাতের মধ্যে তিনি প্রায় ২৫০০ বিডিআর সৈন্যকে টেকনাফ সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। একইসাথে মর্টারের গোলা থেকে শুরু করে প্রায় ২৫ লক্ষ গোলাবারুদ পাঠিয়ে দেন সেখানে। তার আগেই তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন যে মিয়ানমার প্রশাসন এরই মধ্যে সীমান্তে বিপুল পরিমান সৈন্য সমাবেশ করছে বাংলাদেশের উপর আঘাত হানার জন্য। উল্লেখ্য মিয়ানমার প্রায় ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিলো যা বাংলাদেশের মোতায়েন করা সৈন্যের দশগূণ। বিডিআর মহাপরিচালক বুঝতে পেরেছিলেন প্রতিপক্ষের হামলার অপেক্ষা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাই তিনি বাংলাদেশ থেকেই প্রথম আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল দিক নির্দেশনা প্রদান করলেন।

Source- thedailystar.net

আক্রমণের জন্য বিডিআর মহাপরিচালক এক অদ্ভুত সময়কে নির্ধারণ করলেন। সাধারনত যেকোন যুদ্ধ শুরু হয় রাতে কিংবা ভোর বেলায়। অন্যদিকে দুপুরে বা দুপুরের পর সবাই বিশ্রাম নিতেই পছন্দ করে। তাছাড়া দিনের এই সময়টাতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে এক প্রকার অলসতা কাজ করে। তাই বিডিআর মহাপরিচালক আক্রমণের সময় নির্ধারণ করলেন দুপুরবেলা যখন সবাই বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত থাকে।

২০০০ সালের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারিতে দুপুর বেলা বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান আক্রমণের নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে বীর বিক্রমে প্রবলভাবে আক্রমণ করে বিডিআর। হতভম্ব মিয়ানমার বাহিনী কিছু বুঝে উঠার আগেই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। যেখানে মিয়ানমারের পক্ষে তাদের প্রায় সকল বাহিনীর সদস্যরাই ছিল সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছিল শুধুমাত্র বিডিআর সেনারা। সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হওয়ার আগেই তিনদিনের এ যুদ্ধে হার মানতে বাধ্য হয় মিয়ানমার এবং মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আক্রমণ বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়। দশগুণ সৈন্যর বিরুদ্ধে শুধুমাত্র প্রবল সাহস ও যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ মাত্র ৩ দিনেই মিয়ানমারকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো এ যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যা। ৩ দিন ব্যাপি এ যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে প্রাণ হারান নি কোনো সৈন্যই যেখানে মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক মিলিয়ে প্রায় ৬০০ জন নিহত হয়েছিলো। যা এ যুদ্ধে বাংলাদেশের অন্যতম একটি বড় অর্জন।

Source- news.cgtn.com

অবশেষে ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় বসতে রাজী হয় এবং বাংলাদেশ থেকে সচিব পর্যায়ের একটি দল মিয়ানমারের মংড়ুতে যায় আলোচনার জন্য। বাংলাদেশের দলটিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব জানিবুল হক। তিনি জানান আলোচনার সময় মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো। আলোচনায় মিয়ানমার বাঁধ নির্মাণ থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল এবং যার ফলে সাগরগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার হুমকি থেকে বেঁচে যায় আমাদের টেকনাফ অঞ্চল।

নাফ যুদ্ধের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছিল বিডিআর বাহিনীর যার নেতৃত্বে ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যার অসীম সাহসীকতাপূর্ণ অবস্থান ও সিদ্ধান্তের ফলে আমরা সেনাবাহিনী ব্যতিতই এবং কোনো প্রাণহানী ছাড়াই টেকনাফ অঞ্চলকে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে রক্ষা করতে পেরেছিলাম। এই যুদ্ধে অংশ নেয়া বিডিআরের প্রতিটি সদস্যকে সরকার  তাদের সাহসীকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘অপারেশন নাফ পদক’ নামে একটি সম্মানসূচক পদকে ভূষিত করে।

একটি যুদ্ধে বিজয়লাভের জন্য উন্নত অস্ত্রই শেষ কথা নয়। যুদ্ধে জেতার জন্য সবচেয়ে বেশী যা প্রয়োজন তা হলো সাহসীকতা, দৃঢ় মনোবল ও আত্মত্যাগের ইচ্ছা। যে সাহসীকতা, দৃঢ় মনোবল ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাঙালি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হতে স্বাধীনতা অর্জন করে নিয়েছিলো সেই সাহস ও মনোবলের মাধ্যমেই ২০০০ সালে বিডিআর এর বীর সৈনিকরা দশগুণ অধিক সৈন্য ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারকে পরাজিত করেছিলো আর রক্ষা করেছিলো টেকনাফ তথা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে কেনা এই দেশের ভুখন্ডকে।


Warning: printf(): Too few arguments in /home/ranklwxg/alo.com.bd/wp-content/themes/coblog/inc/template-tags.php on line 46

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *