বালি দ্বীপ

May 19, 2014 04:37 pm
Bali Island

নাজমুল হোসেন

অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ ইন্দোনেশিয়ার বালি। পর্যটন শহর বালি দ্বীপের মানুষ পর্যটকদের স্বাগত জানাতে আন্তরিক। পর্যটন শিল্পকে প্রাধান্য দিয়েই শহরটি গড়ে উঠেছে। এই দ্বীপের যতটুকু দেখেছি, তাতেই অভিভূত হয়েছি। দ্বীপটিকে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাই অত্যন্ত আন্তরিক। জনগণ রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের পাতা পর্যন্ত কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলেন। পর্যটকদের অগ্রাধিকার এখানে সব কিছুতে। বসবাসের হোটেল এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক দোকান পর্যন্ত নেই। বালি দ্বীপ ভ্রমণের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে ভ্রমণপিপাসুরা আসেন বালি দ্বীপের প্রাকৃতিক রূপে নিজেদের সিক্ত করতে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে করে আমরা প্রথমে পৌঁছলাম সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে। সেখানে বেশ কয়ক ঘণ্টা যাত্রাবিরতি ছিল। এয়ারপোর্টটি দারুণ জমকালো। তবে ক’ঘণ্টা ওখানে বসে থাকতেই আমরা বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্লেন পরিবর্তন করে ওই একই এয়ারওয়েজের আরেকটি ছোট প্লেনে চড়ে আমরা রওনা দিলাম বালির পথে। আমাদের প্লেন এগিয়ে চলেছে বালির দিকে আর প্লেনের জানালা দিয়ে নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছে কেবল সমুদ্র আর সমুদ্র। বালির আয়তন ৫.৬৩২,৬ কিলোমিটার। বালি প্রদেশটি আটটি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত। বালি দ্বীপটি আসলে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। বালিতে প্রধানত শুষ্ক ও আর্দ্র এই দু’টি মওসুম রয়েছে। তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে।
বালি ইন্দোনেশিয়ার ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ক্ষুদ্রতম প্রদেশ, যার আয়তন মাত্র ৫ হাজার ৭৮০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৪২.২ লাখ। বালির রাজধানী হলো ডেনপাসার (উবহঢ়ধংধৎ)। বালির সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা হলো সমুদ্রসৈকত। সমুদ্রসৈকতে স্পিডবোটে টেনে নেয়া প্যারাসুটে মানুষের আকাশে ওড়ার সুযোগ রয়েছে। সৈকত এলাকা খুবই পরিচ্ছন্ন। এর পাশাপাশি বালিতে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের পুরনো হিন্দু মন্দির। তিন দশক আগেও বালি পুরোপুরি কৃষিনির্ভর ছিল। কিন্তু বর্তমানে বালির মোট অর্থনীতির ৮০ শতাংশ পর্যটন শিল্পের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং একে ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম ধনী প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুসলিম বসবাসকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া হলেও বালির চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। বালিতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৮৪.৫ শতাংশই হিন্দু এবং মন্দিরের আধিক্যের কারণে বালিকে বলা হয় দেবতাদের দ্বীপ, শান্তির দ্বীপ।
আমাদের প্লেন যখন বালি দ্বীপের এয়ারপোর্টের দিকে অবতরণের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যে, আমরা যেন সমুদ্রের মধ্যেই অবতরণ করতে যাচ্ছি। প্লেনের অনেক যাত্রী বেশ হইচই করে উঠল। কিন্তু প্লেনটি ঠিকঠাক মতোই সমুদ্রের কোল ঘেঁষা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। ছোট্ট একটি বিমানবন্দর কিন্তু টুরিস্টদের জন্য রয়েছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এয়ারপোর্টের বাইরে আসার সাথে সাথে একটি বালিনিজ মেয়ে ফুল দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘ডবষপড়সব ঃড় ইধষর’। প্রত্যেক পর্যটককে বালিনিজরা এভাবেই স্বাগতম জানায়।
এর পরে একটি গাড়িতে করে আমরা পৌঁছে গেলাম হোটেল গ্র্যান্ড হায়াতে। হোটেলের রিসেপশনে সব ফরমালিটিজ শেষ করে আমরা আমাদের রুমে চলে যাই। রুমটি বেশ বড় আর ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। সেদিন আমরা কেবল বিশ্রাম নিলাম। পরের দিন খুব সকালে উঠে ব্রেকফাস্টের জন্য হোটেলের ডাইনিং হলে গেলাম। আমি তো অবাক ব্রেকফাস্টের জন্য প্রায় পঞ্চাশ ধরনের খাবার দেখে। যা হোক খাওয়া শেষ করে আমরা হোটেলের একটি গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমরা গাইডের সহায়তায় বালি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের যিনি গাইড ছিলেন তার পরনে ছিল বালির ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি আর ফতুয়া, মাথায় বালির বিশেষ টুপি। তার কাছ থেকে জানলাম বালির অধিবাসীদের প্রধান পেশা পর্যটন শিল্প। কোনো না কোনোভাবে তারা এই শিল্পের সাথে জড়িত। এই এলাকার মানুষের প্রথাগত জীবন ও বৈচিত্র্যময় বসবাস দেখানোর জন্য আমারা গেলাম বালির একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামে। গ্রামে যাওয়ার পথের দু’ধারে ঠিক বাংলাদেশের মতো ফসলের ক্ষেত চোখে পড়ল। আমাদের গ্রামের যে বাড়িটিতে নিয়ে যাওয়া হলো সেটি ছিল একজন হস্তশিল্পীর বাড়ি। সেখানে দেখলাম বেশ কয়েকজন শিল্পী নানা ধরনের হস্তশিল্পের কাজ করছেন। বালি জগৎখ্যাত হস্তশিল্পের জন্য। দ্বীপবাসীর তৈরি কাঠের বা মেটালের বিভিন্ন ঘর সাজানোর দ্রব্যগুলো এক কথায় অসাধারণ। এ ছাড়াও পথে পথে স্যুভেনিয়র শপে বিক্রি হচ্ছে আকর্ষণীয় সব হস্তশিল্প। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে শিল্পীদের হাতে আঁকা তেল ও জল রঙের ছবি। আমি দু’টি ছবি খুব শখ করে কিনে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। এখনো ছবি দু’টি আমার ঘরে অতি যতেœ শোভা পাচ্ছে। যা হোক বালির গ্রামে শিল্পীদের বাড়ি ভ্রমণ শেষে আমরা গেলাম বালির প্রথাগত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে। উপভোগ করি বালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা নৃত্যশিল্পীদের নাচ। ঠিক ইন্দোনেশিয়ার সিনেমায় যেমনটা দেখেছি তেমনই নাচ-গান নিজের চোখে দেখলাম। তারপর গাড়িতে আবার রওনা দিলাম। ইন্দোনেশিয়া মুসলমানপ্রধান দেশ হলেও বালি দ্বীপটি হিন্দুপ্রধান। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল একটি পুরনো সনাতনী মন্দির। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এই মন্দিরে আসে পূজা করতে। মন্দিরে একটি অদ্ভুত বিষয় দেখলাম। প্রচুর বাদুড় রয়েছে মন্দিরে এবং সবাই তাদের বেশ আদর করে। ওই এলাকাটির নাম টেনগানান। সেদিনকার মতো বেড়ানো পালা শেষ করে আমরা হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যার দিকে আশপাশের দোকানপাটে ঘুরতে গেলাম।
বালির সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এলাকা কুটায় (কঁঃধ) অবস্থিত। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব সাড়ে ৩ কিলোমিটার। আমাদের ট্যাক্সি ভাড়া আসল ৮০ হাজার রুপিয়া। প্রতি ডলারের বিনিময়ে আমরা ১১ হাজার ২৫০ রুপিয়া পেয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়ায় সর্বোচ্চ এক লাখ রুপিয়ার নোট পাওয়া যায়। পরবর্তী তিন দিন এই লাখ লাখ রুপিয়ার হিসাব-নিকাশ করতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।
বিকেল ৫টার দিকে সূর্যাস্ত দেখার উদ্দেশ্যে সমুদ্রসৈকতের দিকে পা বাড়ালাম। বালির বিশ্ববিখ্যাত কুটা সমুদ্রসৈকত না দেখলে বালি দেখাই বৃথা হবে। বালির কুটা সমুদ্রসৈকতের পানির রঙ গাঢ় নীল। দেখতে দেখতে মনে হলো কুটা সমুদ্র সৈকত সুন্দর হলেও আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য কোনো অংশেই এর চেয়ে কম নয়।
সাগরে নামার ব্যাপারটা সেই সময়ের জন্য স্থগিত রেখে সূর্যাস্তের পর আমরা কুটা শহর দেখার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। কুটার রাস্তা খুব বেশি প্রশস্ত নয় এবং রাস্তায় প্রচুর মোটরসাইকেল দেখতে পাওয়া যায়। এখানে আরেকটা মজার বিষয় হলো, চালকদের অনেকেই নারী।
বালিতে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ রুপিয়া হলে সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। আমাদের যাত্রা শুরুর সাথে সাথে চোখে পড়ল রাস্তায় দু’ধারে বালিনিজদের অত্যন্ত দৃঢ় সংস্কৃতির ছাপ। বালিনিজরা ঐতিহ্যে খুব বিশ্বাসী। বাড়ির মূল ফটকে ওরা এমন স্থাপত্য শিল্প ব্যবহার করে যা দেখলে এক শ’ বছরের পুরনো মনে হয়। ফুল এবং বাঁশের ব্যবহার সর্বত্র চোখে পড়ার মতো। বাঁশকে নানাভাবে সাজিয়ে বিভিন্ন বাড়ি, মন্দির, দোকান ইত্যাদিতে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। রাস্তার দু’পাশে কাঠের, মাটির, পাথরের তৈরি অবাক করা বিভিন্ন কারুকাজখচিত শিল্প বারবার নজর কাড়ছিল। বালিতে তেমন কোনো সুউচ্চ ঘর-বাড়ি আমাদের চোখে পড়েনি।
শহরের কেন্দ্র ছাড়া অন্যান্য সব এলাকার প্রায় সব বাড়িঘরই ২-৩ তলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের গাড়ি ঝধৎর ফবরি নামে একটি সোনা-রুপার অলঙ্কার বানানোর কারখানা কাম শো-রুমে এসে থামল।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুটা থেকে ৬৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের একটি অঞ্চল যার নাম কিন্তামানি (করহঃধসধহর)। এটি একটি পাহাড়ি এলাকা এবং উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৫০০ ফুট।
কিন্তামানি অঞ্চলের বাতুর (সড়ঁহঃ নধঃঁৎ) নামের জীবন্ত আগ্নেয়গিরি এবং সেই পাহাড় ঘেঁষা বাতুর হৃদ (ষধশব নধঃঁৎ) দেখতেই সেখানে গেলাম আমরা। গন্তব্যে পৌঁছেই আমার মনে হলো এত সুন্দর জায়গা হয়তো খুব কম আছে।
বাতুর পাহাড় ও হ্রদকে পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুটা এবং কিন্তামানির মাঝামাঝি এলাকা ‘উবুদ’ (টনঁফ)। উবুদে আমাদের মূল দেখার বিষয় ছিল পাহাড়ের গায়ে জুম চাষের আকারের অপূর্ব সুন্দর ধানক্ষেত। পর্যটন বালির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলেও বেশিসংখ্যক মানুষ এখনো কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। বালির কৃষিকাজের বেশির ভাগ দখল করে আছে ধান চাষ। ধান চাষটা সুন্দরভাবে করায় এটাও একটা উল্লেখযোগ্য পর্যটক আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে যেন সৃষ্টিকর্তার নিজের হাতে সযতেœ আঁকা কোনো ছবি। ছবিসদৃশ সেই জায়গা থেকে অনেক ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে চললাম। তখনো সন্ধ্যা হতে কিছু সময় বাকি থাকায় হোটেলে ফেরার আগে বালির পূর্ব প্রান্তের অন্য একটি সমুদ্রসৈকতে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম।
কুটা থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে তানাহ লট (ঞধহধয খড়ঃ) নামের মন্দির। বালিতে পর্যটকদের দেখার যেসব স্থাপনা আছে তার বড় অংশজুড়ে আছে বিভিন্ন মন্দির। যেহেতু মন্দিরের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম তাই শুধু এই একটি মন্দিরকেই আমাদের তালিকায় রেখেছিলাম। এটি দেখতে যাওয়ার কারণ হচ্ছে এর অবস্থান। মন্দিরটি সাগরতীরে একটি বড় পাথরখণ্ডের ওপর অবস্থিত এবং জোয়ারের সময় মন্দিরটিকে একটি ছোট দ্বীপের মতোই দেখায়। প্রতিজনের জন্য ৩০ হাজার রুপিয়া দিয়ে টিকিট কেটে আমরা মন্দির এলাকায় প্রবেশ করলাম। মূল মন্দিরের ভেতরে ঢোকার অনুমতি না থাকলেও মন্দিরের স্তম্ভে¢র অর্থাৎ পাথরখণ্ডের একটি উচ্চতা পর্যন্ত ওঠা যায়। তবে পবিত্র পানি দিয়ে হাত, মুখ ধুয়ে কিছু রুপিয়া দান করার পরই সেটা সম্ভব।
পবিত্র পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পর মন্দিরের সেবকেরা আমাদের কানে ফুল ও কপালে কয়েকটি চাল লাগিয়ে ওপরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
তানাহ লট থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণের উলুওয়াটু (টষঁধিঃঁ)। এটি বালির সর্বদক্ষিণের একটি এলাকা। আমাদের উদ্দেশ্য বিখ্যাত উলুওয়াটু সানসেট পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখা।
প্রতিজন ২০ হাজার রুপিয়া দিয়ে টিকিট কেটে উলুওয়াটু সানসেট পয়েন্ট এলাকায় প্রবেশ করলাম। এ এলাকায় বানরের উপদ্রব খুব বেশি। আমরা যখন ছবি তোলায় ব্যস্ত, তখন এক দুষ্টু বানর আমার সানগ্লাস কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল। আমরা সূর্যাস্ত দেখার জন্য যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেটা সাগরের পাশেই অনেক উঁচু একটি পাহাড়। নিচে সাগরের পানি এসে পাথরে আছড়ে পড়ছে। ওপর থেকে নিচে তাকালে রীতিমতো ভয় লাগে। সাগর, পাহাড়, সবুজ বনানী এবং সূর্যাস্ত সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে।
উলুওয়াটুর এই জায়গাটি বালি সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নাচ কেকাক (কবপধশ) পরিবেশনার জন্য বিখ্যাত। সূর্যাস্তের পরপরই কেকাক এবং আগুননাচ শুরু হয়। আমরা এক লাখ রুপিয়া দিয়ে তিনটি টিকিট কেটে বালির এই ভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক নাচ উপভোগ করতে বসে গেলাম। এটি মুক্তমঞ্চে পরিবেশিত হয় এবং দর্শক গ্যালারিতে পর্যটকদের এত ভিড় যে সূচ ধারণের জায়গা নেই। কেকাকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পরিবেশনায় কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।
এ সময় ৬০ জনের মতো বালিনিজ পুরুষ তাদের মুখ দিয়ে একই তালে আওয়াজ করতে থাকে। আর মঞ্চে মূলত সংলাপহীন সংক্ষিপ্ত রামায়ণ মঞ্চস্থ হয়। কেকাকের শুরুটায় একঘেয়েমি থাকলেও আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে এলো । এক সময় বেশ উপভোগ করলাম।
উলুওয়াটু থেকে জিমবারানের (ঔরসনধৎধহ) উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের এবারের উদ্দেশ্য রসনাবিলাস। সি-ফুড না খেয়ে বালি ত্যাগ করলে ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে। উলুওয়াটু থেকে কুটা আসার পথেই জিমবারান এলাকার অবস্থান এবং কুটা থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। সাগরতীরে সি-ফুড রেস্টুরেন্টের জন্য জিমবারান বিখ্যাত। এখানে খোলা আকাশের নিচে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
সাগরের গর্জন ও লাইভ মিউজিক শুনতে শুনতে সি-ফুড খাওয়ার মজা নেয়ার জন্য অবশ্য চড়া মূল্য দিতে হয়। ১০-১২ আইটেমের সি-ফুড খেয়ে আমাদের প্রায় ১০ লাখ রুপিয়া বিল দিতে হলো।
বালিতে কেনাকাটার জন্য কৃষ্ণা (কৎরংযহধ) নামে একটি সুপার শপে প্রবেশ করলাম। আমাদের ড্রাইভার মেডি আগেই জানিয়েছিল যে, এই সুপার শপ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এক দরের দোকান হওয়ায় অতিরিক্ত মূল্য দেয়ার ঝুঁকিও কম থাকে।
বালি দ্বীপটিতে পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে প্রচুর পাব, ডিসকো আর নাইট ক্লাব। এখানে আসা বেশির ভাগ পর্যটকই অস্ট্রেলিয়ার বলে মনে হলো। এ ছাড়াও অন্যান্য দেশের পর্যটকও নজরে পড়ল। রাতে আমরা ছোট একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া করলাম। আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখন হঠাৎই রেস্টুরেন্টটা কেঁপে উঠল। আমরা বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ওখানকার লোকেরা বলল এই রকমের ছোটখাটো ভূমিকম্প প্রায়ই এ দ্বীপে হয়ে থাকে। রাতে হোটেল লাগোয়া সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে গেলাম। রুমে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল। দ্বীপটি খুবই নিরাপদ। চুরি, ছিনতাই বা কোনো কিছু হারানোর ভয়ই নেই। পরের দিন সকালে আমরা সমুদ্রে নেমে পড়লাম। অনেক দেশের পর্যটকদের সাথে সমুদ্রে স্নান করার অভিজ্ঞতাটি দারুণ।
দুপুরের পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য। আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেই জায়গাটি বালির শহর থেকে একটু দূরে। যাওয়ার পাহাড়ি পথে চোখে পড়ল পাহাড়ের ধাপে ধাপে ধানক্ষেত। যাই হোক সূর্য অস্ত দেখতে আমরা পৌঁছলাম সমুদ্রসৈকতে। আমার জীবনে এর আগে আমি কখনো এত সুন্দর প্রকৃতি দেখিনি। বিশাল সুনীল সমুদ্র, তার মাঝে একটা কালো পাথরকে কেটে বানানো হয়েছে বিখ্যাত তানাহ লট টেম্পল। সমুদ্রের হাঁটুজল ভেঙে সেই টেম্পলে আমরা গেলাম। ওপরে নীল আকাশটা ক্রমেই লালচে হয়ে যাচ্ছে আর সূর্যটা এক সময় চার দিককে আঁধার করে ডুবে গেল সমুদ্রের বিশালতায়। আমার মনে হয়েছিল বালি না এলে আমি বঞ্চিত থাকতাম প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য থেকে। পরের দিন আমরা দেখতে গেলাম কিনতামানি বাতুর ভলকেনো। ইন্দোনেশিয়ার এই দ্বীপে আগে একবার এই অগ্নিগিরি থেকে অগ্নি উৎপাত হয়ে বহু মানুষ আর গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। এখন এই আগ্নেয়গিরিটি শান্ত। আমরা পাহাড়ি পথ ধরে গেলাম আগ্নেয়গিরিটি দেখতে। বেশ দূর থেকে গিরিটি দেখলাম। দেখতে দেখতে মনে হলো এই শান্ত সুবিশাল পাহাড়ের মুখ থেকে বের হওয়া লাভা কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে অথচ এখন এটি কত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
বালিতে বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এমনকি কাজ করতে আসা কোনো বাংলাদেশীও আমি দেখতে পাইনি। এয়ারপোর্ট আনুষ্ঠানিকতার শেষ মুহূর্তে এসে জানতে পারলাম যে, প্রত্যেক পর্যটককে ভ্রমণ শেষে এক লাখ ৫০ হাজার রুপিয়া ট্যাক্স দিতে হয়। এটি ডলারেও পরিশোধ করা যাবে। বেলা সাড়ে ১২টায় আমাদের বিমান চলতে শুরু করল। সাগরকে দু’ভাগ করা রানওয়ে ধরে আমাদের বিমানের গতি বাড়তে থাকল। মনে মনে বললাম ‘বিদায় বালি’। বালির অনন্যসুন্দর মুহূর্তগুলোর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
নির্বাহী সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
অন্যদিগন্ত সম্পাদনা : আলফাজ আনাম

Email: info@onnodiganta.com

যোগাযোগ

১৬৭/২ ই, ইনার সার্কুলার রোড, ইডেন কমপ্লেক্স, মতিঝিল,ঢাকা-১০০০
ফোন:৭১৯১০১৭-৯,৭১৯৩৩৮৩-৪ সার্কুলেশন : ৭১৯২০০২

Follow Us